লিফোন কে আবিষ্কার করেন (Who Invented the telephone) ? টেলিফোন আবিষ্কারের ইতিহাস কি ? আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি।
আজকের মোবাইল-স্মার্টফোনের দৌলতে যোগাযোগ যেন হাতের মুঠোয় বন্দি।
তবে, এই মোবাইল, ল্যাপটপ এমনকি কম্পিউটারের আগে মানুষের জীবনটা ঠিক কেমন ছিল ?
আসলে, ১৯ শতকের শেষের দিকে মানুষের যোগাযোগের সবথেকে দ্রুত উপায় কিন্তু ছিল একমাত্র চিঠি প্রেরণ।
ওই সময়ে রেলব্যবস্থার বহুল প্রগ্রতি হওয়ার দরুন, চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ পূর্বের তুলনায় দ্রুততর হলেও; আদতেও তা সময়ে সাথে পাল্লা দিয়ে খবর বিনিময় করতে উঠতে পারতো না।
যার ফলে, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা বড়সড় ফাঁক রয়েই যেত।
পরবর্তীতে, যদিও টেলিগ্রাফের আগমন আরও বেশি দূরত্বে বার্তা প্রেরণের অনুমতি দিতো।
এমনকি, এই যন্ত্রই প্রথম দ্রুত যোগাযোগের ভিত্তি স্থাপন করে থাকলেও এই মাধ্যমের দ্বারা খুব স্বল্প শব্দ ব্যবহার করেই বার্তা পাঠানো যেত।
কারণ, এই যোগাযোগ মাধ্যম ছিল অনেকটাই বেশি খরচসাপেক্ষ।
আর এদিকে আমরা সবাই জানি যে, নেসেসিটি ইস দ্য মাদার অফ ইনভেনশন।
অর্থাৎ, দ্রুত যোগাযোগের প্রয়োজনেই মানব সভ্যতার বুকে পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হয় টেলিফোন।
আর, আজকের আমাদের এই আর্টিকেলের মুখ্য বিষয়ই হল – টেলিফোন (Telephone)।
এই লেখা থেকে আপনারা পেয়ে যাবেন – টেলিফোনের আবিষ্কার, আবিষ্কর্তা, ইতিহাস ও আধুনিক টেলিফোন ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা বিস্তারিত আলোচনা।
আসলে, টেলিফোন কি ?
এখনকার সময়ে ফোনে কথা বলা অত্যাশ্চার্য ঘটনা মনে না হলেও, টেলিফোন হল এমন একটি যন্ত্র, যা মানুষের গলার স্বরকে যুগপত প্রেরণ ও গ্রহণের জন্য বহুকাল আগে তৈরী করা হয়েছিল।
তখনকার দিনে, অন্য যেকোনো যোগাযোগ মাধ্যমের থেকে টেলিফোন গুলো ছিল অনেকটাই সস্তা ও সহজে পরিচালনযোগ্য, তাত্ক্ষণিক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের সেরা মাধ্যম এবং এখনও এই ব্যবস্থা রয়ে গিয়েছে।
বর্তমানেও, সারা দুনিয়াতে প্রায় কোটি কোটি টেলিফোন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
টেলিফোন কে আবিষ্কার করেন ?
আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল আমরা সবাই টেলিফোনের জনক হিসেবে চিনি।
তাঁর পেটেন্ট ও “টেলিগ্রাফিকভাবে কণ্ঠ বা অন্যান্য শব্দ প্রেরণ করার জন্য… বৈদ্যুতিক অনিয়ম ঘটাতে”- তিনি যে যন্ত্র তৈরী করেছিলেন, সে যন্ত্রের প্রদর্শনে তিনিই প্রথম সফল হয়েছিলেন বলেই, তাঁকে টেলিফোনের আবিষ্কারক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
টেলিফোন কত সালে আবিষ্কার হয় ?
বেলের একজন সহকারী টমাস এ. ওয়াটসন একটা টেলিগ্রাফ ট্রান্সমিটার নতুন করে সক্রিয় করার চেষ্টা করছিলেন।
সেই শব্দ শুনে বেল মনে করেছিলেন যে, তিনি একটি তারের সাহায্যে মানুষের গলার স্বর অন্যত্র পাঠানোর যে সমস্যা, তার সমাধান করতে পারেন।
তিনি আগেই একটা সাধারণ বিদ্যুৎ প্রবাহকে কীভাবে প্রেরণ করতে হয়, তা আবিষ্কার করেছিলেন।
পরবর্তীতে, তিনি ৭ই মার্চ ১৮৭৬ সালে এই আবিষ্কারের জন্য একটা পেটেন্ট নেন।
এর ঠিক পাঁচ দিন পরে, তিনি প্রথম তাঁর এই পেটেন্ট নেওয়া যন্ত্রটি ব্যবহার করে, প্রথম ও প্রকৃত বার্তা প্রেরণ করেছিলেন।
তিনি একটি ঘরে বসেন ও অন্য ঘরে বসে থাকা তাঁর সহকারীর সাথে ফোনের মাধ্যমে কথা বলেন।
ফোনে তাঁর প্রথম ঐতিহাসিক বক্তব্য ছিল এই যে, “এখানে আসুন, মিস্টার ওয়াটসন। আপনাকে আমি দেখতে চাই।”
যা পরবর্তীতে, আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ইতিহাসে সেরা পেটেন্টগুলো মধ্যে অন্যতম পেটেন্ট হয়ে রয়ে গিয়েছে।
টেলিফোন আবিষ্কারের ইতিহাস:
একটি নির্দিষ্ট উদ্ভাবনের জন্য সত্যিকারের উদ্ভাবক বা উদ্ভাবকদের খুঁজে বের করা অনেকটাই কঠিন হতে পারে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, মূল আবিষ্কারকের বদলে, যে বা যাঁদের আবিষ্কার সেরা ও ব্যবহারিক দিক থেকে সফল হয়, তিনি বা তাঁদেরকেই প্রধান উদ্ভাবকের তর্জমা দেওয়া হয়ে থাকে।
আর, এই টেলিফোনের মতো এমন ঐতিহাসিক আবিষ্কারের প্রকৃত আবিষ্কর্তা নিয়ে ইতিহাসে নানান ধরণের বিতর্কও রয়েছে।
এমনকি, আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়েও বহু বিতর্কিত মামলা-মোকদ্দমা, প্রতিবেদন, বই ও নিবন্ধও তৈরী করা হয়েছে।
তবে, নিঃসন্দেহে, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলই টেলিফোনের উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত হন।
কারণ, তাঁর দ্বারা পরিচালিত টেলিফোনের নকশাকেই প্রথম পেটেন্ট হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।
তবে, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি টক টেলিগ্রাফের ধারণা সর্বসমক্ষে নিয়ে আসেন।
বরং, একজন ইতালীয় অভিবাসী, আন্তোনিও মেউচ্চি ১৮৪৯ সালে কথা-বলা টেলিগ্রাফ বা টেলিফোনের নকশা তৈরির সূচনা করেন।
এরপর, ১৮৭১ সাল নাগাদ, তিনি এই কথা-বলা টেলিগ্রাফের ডিজাইনের জন্য একটা সতর্কতা (একটি উদ্ভাবনের ঘোষণা) দাখিল করেন।
কিন্তু, কোনো কারণবশত, মিউচি তাঁর সেই উদ্ভাবনের ঘোষণা পত্রটি রিনিউ করতে পারেননি।
যে কারণে, তিনি টেলিফোনের নকশার আবিষ্কার করা সত্ত্বেও, ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখানোর সুযোগ না পাওয়াও, টেলিফোনের আবিষ্কারক হওয়ার কৃতিত্বটা তাঁর কাছে অধরাই থেকে যায়।
পরবর্তীকালে,
আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদ ২০০২ সালে একটা রেজোলিউশন পাস করে মেউচ্চির কাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে তাঁর অবদানকে অবিস্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করেছে।
এছাড়াও, এলিশা গ্রে নামের এক আমেরিকান উদ্ভাবক ও ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথেও, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের টেলিফোনের আবিষ্কারকে ঘিরে একটা বিখ্যাত আইনি লড়াইও হয়েছিল।
গ্রে ১৮৭৬ সালেই একটা ওয়াটার মাইক্রোফোন ব্যবহার করে এক ধরণের টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন।
তবে, আইনি জয়টা অবশ্যই হয়েছিল গ্রাহামেরই এবং ইতিহাসও সেই সাক্ষীই বহন করে চলেছে।
আরও, জানা যায় যে, টমাস আলভা এডিসন কার্বন মাইক্রোফোন আবিষ্কার করেছিলেন।
যেটা কিনা শক্তিশালী টেলিফোন সংকেত তৈরি করতে পারে; তবে এই আবিষ্কারের পেটেন্ট তিনি কোনোদিনই নেননি।
টেলিফোন কিভাবে কাজ করে ?
একটা টেলিফোনের কাজ খুবই জটিল; কিন্তু বুঝতে পারা খুবই সহজ।
যদি, আপনি ছোটবেলায় দুটো কাগজের কাপকে একটা তারের সাথে বেঁধে কথা বলে থাকেন, তাহলে আপনি ইতিমধ্যেই বুঝতে পারবেন যে, টেলিফোন কিভাবে কাজ করে।
ওই দুটো কাগজের কাপের দুই দিকে থাকা দুটো মানুষ কাপের মধ্যে যে কথা বলে, সেই কথাই শব্দ তরঙ্গের আকারে তারের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দুই প্রান্তে থাকা ব্যক্তির কানে পৌঁছে যায়।
মূলত, যেকোনো টেলিফোনেই থাকে – কথা বলার জন্যে একটা মাইক্রোফোন ও কথা শোনার জন্যে একটা স্পিকার।
ঠিক তেমনই, আপনি যখন একটি টেলিফোনে কথা বলেন, তখন আপনার গলার শব্দ ছোট-ছোট শব্দ তরঙ্গের আকারে ফোনের মাইক্রোফোনের ভিতরে থাকা একটা পাতলা ধাতব ডিস্কে অর্থাৎ ডায়াফ্রামে পৌঁছোয়।
আর, সেই ডায়াফ্রামে আপনার প্রেরিত শব্দ তরঙ্গটি কম্পনের সৃষ্টি করে।
কম্পন তৈরীর সাথে-সাথেই শব্দ তরঙ্গগুলো বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
এইবার, ওই তড়িৎ শক্তি আপনার টেলিফোনের তারের মাধ্যমে, অন্যদিকে থাকা ব্যক্তির টেলিফোনের স্পীকারে থাকা স্থায়ী ম্যাগনেট ও একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটের সাহায্যে পুনরায় বৈদ্যুতিক শক্তি থেকে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়।
আর এইভাবেই, আপনার গলার স্বরের আকারে বার্তা অন্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যায় ও সে স্পষ্টভাবে আপনার কথা শুনতে পায়।
সোজা ভাষায় বলতে গেলে, টেলিফোন সিস্টেম শব্দ শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে।
আর, এই বৈদ্যুতিক শক্তি ফোনের তারের মাধ্যমে ভ্রমণ করে সোজা অন্যপ্রান্তে থাকা টেলিফোনে পুনরায় অ্যাকোস্টিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে পৌঁছে যায়।
টেলিফোন কি কি উপাদান নিয়ে তৈরী ?
টেলিফোন যন্ত্রগুলো একটা পাওয়ার উৎস, সুইচ হুক, ডায়লার, রিংগার, ট্রান্সমিটার, রিসিভার ও অ্যান্টি-সিডটোন সার্কিট নিয়ে তৈরী৷
- ইলেক্ট্রোম্যাগনেটের সাহায্যে টেলিফোনে তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্ট করা হয়ে থাকে।
- ফোনগুলোকে সুইচ হুক স্থানীয় লুপের মধ্যে ধরে রেখে সরাসরি কারেন্টের সাথে যুক্ত করে রাখে।
- আপনি যাকে ফোন করতে চাইছেন, তার নম্বর লেখার জন্যে ডায়ালার ব্যবহার করা হয়।
- রিংগার হল কোনো ফোন এলে, ব্যবহারকারীকে জানান দেওয়ার জন্যে টেলিফোনে যুক্ত করা থাকে।
- যেটা কোনো ইনকামিং কল এলেই একটা শ্রবণযোগ্য রিং বা টোন নির্গত করে ব্যবহারকারীকে কল সম্পর্কে সতর্ক করে।
- একটি ট্রান্সমিটার হল টেলিফোনের মাইক্রোফোনে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মাইক্রোফোন।
- এটি আপনার গলার স্বরের কম্পনকে আপনার টেলিফোন থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ প্রবাহে রূপান্তরিত করে।
ফোন কিভাবে করা হয় ?
ফোন করার সময়ে আপনাকে শুধুমাত্র রিসিভারটা তুলে আপনার কাঙ্খিত ফোন নাম্বারে ফোন করলেই, আপনার উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে ফোন চলে যাবে।
কিংবা, আপনার যখন ফোন আসবে, তখন আপনাকে ওই রিসিভারটা তুলেই ফোনে কথা বলতে হয়।
আধুনিক টেলিফোন:
আগেকার টেলিফোনে কেবলমাত্র কথাবার্তা আদান-প্রদান করা গেলেও, ১৯৭৩ সালে টেলিফোনের থেকে সেলফোনের আবিষ্কার সমস্ত টেলিযোগাযোগের চিন্তাভাবনকেই সম্পূর্ণ বদলে দেয়।
যেখানে, টেলিফোনে তার ছাড়া যোগাযোগ একেবারে অসম্ভব ছিল, সেলফোন আসার ফলে তারবিহীন রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে আরও দূরের যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠে।
এরপর, ইন্টারনেট প্রযুক্তি, কম্পিউটার প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির মিলনে, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে – আরও ডায়নামিক, সহজ, স্বচ্ছ ও কম ব্যয়সাপেক্ষ।
এখনকার স্মার্টফোনে আমরা সাধারণ কলের পাশাপাশি, অডিও-ভিডিও কল, ই-মেইল পাঠানো, লিখিত টেক্সট পাঠানো, গান শোনা, সিনেমা দেখা, অ্যালার্ম দেওয়া ও নানান ধরণের কাজ নিমেষের মধ্যেই করে থাকি।
এতসব কান্ড কোনোদিনও সম্ভব হয়ে উঠতো না, যদি না মানব সমাজ টেলিফোন নামক এই বিস্ময়কারী যন্ত্রটি আবিষ্কার করে উঠতে পারতো।
এই কারণেই, টেলিফোনকে আমরা বর্তমান মোবাইলের ঠাকুর্দা হিসেবে অভিহিত করতেই পারি।
যেই যন্ত্রটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানান পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের স্মার্টফোন হিসেবে দৃশ্যমান হতে পেরেছে।
টেলিফোন কে আবিষ্কার করেন ? এবং টেলিফোন আবিষ্কারের ইতিহাস কি নিয়ে লিখা আমাদের আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
লেখাটি পছন্দ হলে অবশ্যই তা কমেন্টে জানাবেন।