আপনি যদি একটি কিছুটা মডার্ন স্মার্টফোনও ব্যবহার করেন, তাহলে খুব সম্ভবত আপনার ফোনের সামনে বা পেছনে একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার আছে এবং সেটাকে আপনি প্রত্যেকদিনই অনেকবার ব্যবহার করেন ফোনের স্ক্রিন আনলক করার কাজে। অন্তত ২০১৬ এর পড়ে রিলিজ হওয়া প্রত্যেকটি হাই এন্ড এবং মিড এন্ড স্মার্টফোনে স্ক্রিন আনলক করার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার থাকেই (আইফোন এক্স ছাড়া)। আমার মতে এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার হচ্ছে এখনো পর্যন্ত স্মার্টফোন আনলক করার সবথেকে সিকিওর এবং সবথেকে ফাংশনাল মেথড। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন বা জানতে চেয়েছেন যে কিভাবে কাজ করে স্মার্টফোনে থাকা এসব ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার? কিভাবেই বা এগুলো আপনার আঙ্গুলের ছাপ সঠিকভাবে রিড করতে পারে এবং পরেরবার রিকগনাইজ করতে পারে? আজকে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা যাক।
প্রথমত জানতে হবে যে, স্মার্টফোনে সাধারনত কয় ধরনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার থাকে। হ্যাঁ, ঠিক বুঝেছেন। সব স্মার্টফোনে একই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার থাকেনা। সাধারনত স্মার্টফোনে তিন প্রকারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর দেখা যায়-
১। অপটিক্যাল স্ক্যানার
২। ক্যাপাসিটিভ স্ক্যানার
৩। আলট্রাসনিক স্ক্যানার
এই তিনটি স্ক্যানার কিভাবে কাজ করে এবং কিভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিড এবং রিকগনাইজ করে তাই নিয়েই আজকে আলোচনা করবো। প্রথমেই জানা যাক,
অপটিক্যাল স্ক্যানার
এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার হচ্ছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিড এবং রিকগনাইজ করার সবথেকে পুরনো মেথড। নাম শুনেই হয়তো কিছুটা ধারনা করতে পারছেন যে এটি কিভাবে কাজ করতে পারে। এই স্ক্যানারগুলো মূলত আপনার হাতের আঙ্গুলের একটি অপটিক্যাল ইমেজ বা ফটোগ্রাফ তৈরি করে। ইমেজ তৈরির পরে এই স্ক্যানার তার নিজস্ব অ্যালগরিদমের সাহায্যে আপনার আঙ্গুলের ইউনিক ফিচারসগুলোকে ডিটেক্ট করে। যেমন আপনার হাতের আঙ্গুলের স্পেশাল কার্ভগুলো, ভাঁজ, লাইন ইত্যাদি ডিটেক্ট করে। মুলত এসব ডিটেক্ট করা হয় ক্যাপচার করা ইমেজটির লাইট এবং ডার্ক এরিয়াগুলোকে কম্পেয়ার করার মাধ্যমে। স্মার্টফোনের ক্যামেরার ন্যায় এসব স্ক্যানারগুলোরও নিজস্ব রেজুলেশন থাকতে পারে এবং স্মার্টফোন ক্যামেরার মতই, যত বেশি রেজুলেশন তত বেশি ডিটেইলড ইমেজ তৈরি করবে এবং এর ফলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিকগনিশনও আরও বেটার এবং আরও ফাস্ট ও আরও বেশি সিকিওর হবে।
এরপর নিশ্চই ধারনা করতে পারছেন যে, যখন আপনি দ্বিতীয়বার ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারটির ওপরে আঙ্গুল রাখেন তখন স্ক্যানারটি আগের তৈরি অপটিক্যাল ইমেজের সাথে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্টটিকে ম্যাচ করে এবং ম্যাচ করতে সাকসেসফুল হলেই আপনার ফোনটি আনলক করতে দেয়। কিন্তু এই স্ক্যানারগুলোর কিছু ড্রব্যাক আছে। প্রথমত, যেহেতু এই স্ক্যানারটি শুধুমাত্র আপনার আঙ্গুলের ছাপের একটি অপটিক্যাল ইমেজ নিয়েই কাজ করে এবং ইমেজের ওপরেই নির্ভর করে আপনার ফোন আনলক করে, তাই এই স্ক্যানারগুলোকে বোকা বানানো অন্যান্য স্ক্যানারের তুলনায় অনেক সহজ। আপনি যদি আপনার আঙ্গুলের ছাপের ছোট একটি নিখুঁত ফটোগ্রাফ যোগাড় করতে পারেন, তাহলে সেটি ব্যবহার করেই এই স্ক্যানারটিকে অনেকটা বোকা বানানো সম্ভব। তাই এসব ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার এখন আর হাই এন্ড এবং মিড এন্ড স্মার্টফোনে ব্যবহার করা হয়না। এখনকার সময়ে এই ধরনের স্ক্যানার আপনি শুধুমাত্র খুবই লো প্রাইজের স্মার্টফোনগুলোতে দেখতে পাবেন। এবার জানা যাক,
ক্যাপাসিটিভ স্ক্যানার
এখনকার সময়ে এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার হচ্ছে সবথেকে বেশি ব্যবহার করা স্ক্যানার। এই ক্যাপাসিটিভ স্ক্যানারগুলো আপনি আপার মিডরেঞ্জ স্মার্টফোনগুলো থেকে শুরু করে হাই এন্ড বা ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনগুলোতে অনেক বেশি দেখতে পাবেন। অপটিক্যাল স্ক্যানারের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে, এই স্ক্যানারটি একটি ছোট একটি ইলেকট্রিক কম্পোনেন্টের ওপরে নির্ভর করে কাজ করে যেটির নাম হচ্ছে, ক্যাপাসিটর। এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারগুলো আপনার আঙ্গুলের ছাপের একটি ট্রেডিশনাল ইমেজ তৈরি করার বদলে, কিছু ছোট ছোট ক্যাপাসিটর সার্কিট ব্যবহার করে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পর্কে অ্যানাফ ডেটা কালেক্ট করার জন্য। যেহেতু ক্যাপাসিটর ইলেকট্রিক চার্জ স্টোর করতে পারে, তাই এসব ক্যাপাসিটরগুলোকে স্ক্যানারের সার্ফেসের কন্ডাক্টিভ প্লেটের ওপরে বসানোর মাধ্যমে আপনার আঙ্গুলের ছাপের ডিটেইলসগুলো কালেক্ট করা সম্ভব হয়।
যখন আপনার আঙ্গুল এই স্ক্যানারের ওপরে প্লেস করা হয়, তখন এই ক্যাপাসিটরে থাকা চার্জগুলো কিছুটা চেঞ্জ হবে। আর আপনার আঙ্গুলের ছাপ এবং স্ক্যানারের মাঝে যে বাতাসের গ্যাপটুকু আছে, সেটির ফলে চার্জগুলো প্রায় অপরিবর্তিতভাবেই এসব ক্যাপাসিটরের ওপরে পড়বে। এরপর একটি ইন্টাগ্রেটর সার্কিট ব্যবহার করে এসব চেঞ্জকে ট্র্যাক করা হয় এবং অ্যানালগ-ডিজিটাল কনভার্টার ব্যবহার করে সেভ করা হয়। এই সেভ করা ডেটাগুলো এবার অ্যালানাইজ করে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ইউনিক ফিচারস এবং অ্যাট্রিবিউট বের করা হয় যেগুলোকে আবার সেভ করা হয় পরবর্তীতে আরও রিলায়েবলভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান করা জন্য। এর ফলে যে লাভটি হয় তা হচ্ছে, এই সেভ করা ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্নটিকে কোন ইমেজের সাহায্যে বোকা বানানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে যেহেতু, অন্যরকম কোন ম্যাটেরিয়াল স্ক্যানারের ক্যাপাসিটরের ওপরে অন্য ধরনের চার্জ তৈরি করবে যেটি আগের সেভ করা প্যাটার্নের সাথে কখনোই মিলবে না।
এক্ষেত্রে স্ক্যানারে যত বেশি ক্যাপাসিটর থাকবে, ফিঙ্গারপ্রিন্টটি তত বেশি অ্যাকিউরেটভাবে রেকর্ড হতে পারবে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিকগনিশন আরও বেশি ফাস্ট এবং রেসপনসিভ হবে। যেহেতু এই স্ক্যানারে প্রায় হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্যাপাসিটর রাখতে হয়, তাই এই স্ক্যানারগুলো তৈরি করা অপটিক্যাল স্ক্যানারের তুলনায় একটু বেশি এক্সপেনসিভ। আর এইজন্যই এসব ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার কমদামী স্মার্টফোনগুলোতে ব্যবহার করা হয়না বললেই চলে।
আলট্রাসনিক স্ক্যানার
এই টেকনোলজিটি হচ্ছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং এর নতুন এবং অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি অ্যাডভান্সড। এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারটি সর্বপ্রথম Leeco Le Max Pro স্মার্টফোনে ব্যবহার করা হয়। কোয়ালকম এবং এর সেন্স আইডি টেকনোলজিও এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারটির একটি প্রধান ডিজাইন এলিমেন্ট। এই স্ক্যানারগুলোর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ক্যাপচার এবং রিকগনিশন বেশ সহজ এবং স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড। এই স্ক্যানারটি মূলত ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান করতে একটি আলট্রাসনিক ট্রান্সমিটর এবং এর একটি রিসিভার ব্যবহার করে থাকে। যে আঙ্গুলটি এই স্ক্যানারের ওপরে প্লেস করা হয়, এই স্ক্যানারটি ঐ আঙ্গুলটির বা ফিঙ্গারপ্রিন্টটির বিপরীতে একধরনের আলট্রাসনিক পালস ট্রান্সমিট করে। এই পালসগুলোর কিছু কিছু আঙ্গুল শোষণ করে নেয় এবং কিছু কিছু স্ক্যানারে ফেরত পাঠায় আপনার আঙ্গুলের কার্ভ, ভাঁজ এবং লাইনগুলোর গভীরত্বের ওপরে নির্ভর করে। যেগুলো ফেরত পাঠানো হয়, সেগুলো রিসিভার দ্বারা রিসিভ করা হয়।
এই ফেরত আসা পালসগুলোকে রিসিভ করার মাধ্যমেই স্ক্যানারটি আপনার আঙ্গুলের একটি যথেষ্ট অ্যাকিউরেট ডেটা পেয়ে যায় যা পরবর্তীতে আবার আঙ্গুলের ছাপ রিকগনাইজ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। এই ডেটাগুলো প্রত্যেকের আঙ্গুলের জন্য ইউনিক। আর যেহেতু এই স্ক্যানারটি আঙ্গুলের ছাপের গভিরতার ওপরও ভিত্তি করে ডেটা তৈরি করছে, তাই এটি সবশেষে যা পায় তা হচ্ছে আপনার আঙ্গুলের ছাপের প্রায় অ্যাকিউরেট একটি থ্রিডি স্ক্যানিং। এর ফলে এই স্ক্যানারগুলোকে বোকা বানানো প্রায় অসম্ভবই বলতে পারেন। এই স্ক্যানারগুলো ক্যাপাসিটিভ স্ক্যানারের থেকেও অনেকগুন সিকিওর। এই স্ক্যানারটি এখনো অনেকটাই নতুন। তাই এই স্ক্যানারগুলোকে আপনি অনেক বেশি স্মার্টফোনে দেখতে পাবেন না। এছাড়া এবছর ভিভো তাদের একটি স্মার্টফোনে এই স্ক্যানারটির আরেকটি আপগ্রেডেড ভার্সন শো অফ করেছে যেটি স্ক্রিনের অর্থাৎ ডিসপ্লের নিচে থেকেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান করতে পারে। কিন্তু সেটি অন্যান্য স্ক্যানার এর তুলনায় ততটা রিলায়েবল এবং রেসপনসিভ নয়।
তো এই ছিল ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারগুলো কিভাবে কাজ করে তার একটি ছোট ব্যাখ্যা। আজকের মত এখানেই শেষ করছি। আশা করি আজকের আর্টিকেলটিও আপনাদের ভালো লেগেছে। কোন ধরনের প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।