চায়নাতে সব জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন সার্ভিস কেন নিষিদ্ধ?
চায়নাতে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন সার্ভিস নিষিদ্ধ?
আপনি যদি প্রযুক্তি নিয়ে খুব ভালো খোঁজ-খবর রাখেন, তাহলে আপনি হয়তো জানেন এবং অনেকবার শুনেছেন যে, চায়নাতে ফেসবুক,গুগলসহ আরও জনপ্রিয় প্রায় সব সোশ্যাল মিডিয়া এবং আরও অনেক জনপ্রিয় অনলাইন সার্ভিস যেমন স্পোটিফাই এবং উবার ইত্যাদি সবকিছুই চায়নার সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ, চায়নাতে বসবাসকারী নাগরিকরা কেউই লিগ্যালি এসব সার্ভিস এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারবে না। এটা কেমন বিচার? নিশ্চয়ই এটা খুব একটা ভালো ব্যাপার না পৃথিবীর অন্যান্য রিজিয়নের ইন্টারনেট হ্যাবিটের সাথে তুলনা করে বিচার করলে। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন যে কেন এমন করেছে চায়নার সরকার? তাদের এসব সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন সার্ভিসগুলোর সাথে সমস্যাটি কি? কেনই বা তারা এই সবকিছু ব্যান করে রেখেছে? চলুন, আজকে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা যাক। চায়নাতে এসব সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস নিষিদ্ধ করার মূলত দুটি কারণ আছে বা থাকা উচিৎ। প্রথমটি হচ্ছে,
সিটিজেনদের কন্ট্রোল করা
সাধারনভাবে চিন্তা করলে যে, একটা দেশের সরকার কেন এসব সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস কেন ব্যান করবে, এটাই মাথায় আসবে যে দেশের সরকার তার নাগরিকদের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে। তাদের দেশের নাগরিকরা কোন কোন সোর্স থেকে ইনফরমেশন জানতে পারবে সেটাও তাদের সরকার নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতে চায়। ঠিক এই কারনে এমনকি চায়নাতে উইকিপিডিয়াও ব্যানড এবং একইসাথে আরও জনপ্রিয় সব নিউজ সোর্ডিয়া যেমন Wall Street Journal, The Economist, Bloomberg ইত্যাদি। এছাড়া জনপ্রিয় সব মুভি, মিউজিক এবং ভিডিও এবং এগুলোর স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না হলেও এগুলোকে সরকার তাদের জনগনদের জন্য বাছাই করে করে অ্যাক্সেস দেয়। যেমন- চায়নাতে নেটফ্লিক্স তাদের নিজেদের ইচ্ছামত কন্টেন্ট রাখতে পারেনা। নেটফ্লিক্সকে মূলত তাদের কন্টেন্টগুলোকে চায়নার লোকাল কম্পিটেটরদের সাহায্যে লাইসেন্স করতে হয় এবং সরকারের তত্ত্বাবধায়নে কনজিউমারদের কাছে আনে। প্রত্যেকবছর শুধুমাত্র ৩৪ টি গ্লোবাল মুভি চায়না রিজিয়নের ভেতরে আসতে পারে। আর যেগুলো রিলিজ হয় সেগুলোও বেসিকালি সুপারহিরো টাইপের মুভি বা কার্টুন মুভি। এমন কোনো মুভি চায়নার সরকার তাদের দেশে অনুমোদন দেয়না যেগুলোতে অন্য কোন দেশের কোন হিস্টোরিকাল ইস্যু বা এই ধরনের কোন কন্ট্রোভার্সি আছে। কারণ, তাদের সরকার জনগণদের ওপরে ফুল কন্ট্রোল রাখতে চায়।
এই ঠিক একই কারনে জনপ্রিয় ব্লগিং প্লাটফর্ম যেমন গুগল ব্লগার, জনপ্রিয় ভিডিও প্লাটফর্ম ইউটিউব ইত্যাদি সবকিছুই চায়নাতে নিষিদ্ধ। কারণ, সেখানে যেকেউ তার নিজের ইচ্ছামত যেকোনো কন্টেন্ট পাবলিশ করতে পারে এবং চায়নার সরকার সেগুলোকে নিজের ইচ্ছামত টিউন করতে পারবেনা বা কাস্টোমাইজ করতে পারবে না। এছাড়া চায়নার সরকার এটাও নিয়ন্ত্রন করে যে তাদের জনগনরা অনলাইনে কোন সার্ভিস কিভাবে অ্যাক্সেস করবে। যার ফলে গুগল এবং ডাকডাকগো এর মত বৃহৎ সার্চ ইঞ্জিনগুলোও নিষিদ্ধ। কারণ, তারা চায়নার সরকারের কথামতো তাদের সার্চ রেজাল্টগুলোকে সেন্সর করতে রাজী হয়নি। ঠিক এই একইভাবে জনপ্রিয় সকল সোশ্যাল মিডিয়া সার্ভিস এবং ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস যেমন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, টেলিগ্রাম এবং এমনকি স্ল্যাকও চায়নাতে নিষিদ্ধ। কারণ চায়নার সরকার এসব প্লাটফর্ম এর বিহেভিয়র এবং ডেটা নিজের ইচ্ছামত কন্ট্রোল করতে পারবে না। এসব সার্ভিস ব্যান করার মেজর একটি কারণ হচ্ছে এটাই।
এছাড়া, চায়না তাদের নিজেদের জনগনের ব্যাপারে বলতে পারেন অনেকটা রক্ষনশীল। চায়নার ভেতরে তাদের নিজেদের যেসব মেজর সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস আছে, যেমন Wechat বা আরও অনেক বিদঘুটে নামের সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদিতে যখন ইউজাররা অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করে, তখন তাদেরকে অ্যাকাউন্টের সাথে তাদের পারসোনাল আইডি নম্বর লিংক করতে করতে হয়। এটা চায়নাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার অন্যতম একটি পূর্বশর্ত। এছাড়া চায়নাতে যেসব টেক ইন্ডাস্ট্রি আছে এবং তাদের যেসব সার্ভিস আছে, সেগুলোর ডেটা সেন্টার চায়নার ভেতরেই থাকা বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয়, সেসব ডেটা সেন্টারে চায়নার সরকারের সম্পূর্ণ অ্যাক্সেসও থাকতে হবে। এবার নিশ্চয়ই ধারনা করতে পারছেন যে চায়নার সরকার তাদের জনগনদের এবং তাদের জনগনদের দ্বারা অ্যাক্সেস করা সব ধরনের ডেটার ওপরে ঠিক কতটা কন্ট্রোল রাখতে চায়। আর এই সেন্সরশিপের আরেকটি কারণ বলতে পারেন,
মিলিটারি সিকিউরিটি
একবার ভেবে দেখুন, যেসব জনপ্রিয় অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়া, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস এবং টেক ইন্ডাস্ট্রিকে চায়না ব্যান করে রেখেছে, যেমন ফেসবুক, গুগল, টুইটার ইত্যাদি, তারা তাদের ইউজারদের কাছে থেকে কি বিপুল পরিমান ডেটা কালেক্ট করে বা করতে পারে। তারা তাদের ইউজারদের কাছ থেকে আক্ষরিক অর্থেই এত বেশি ডেটা কালেক্ট করে যেগুলোকে তারা ঐ ইউজারের বসবাস করা দেশের বিরুদ্ধে এক ধরনের অস্ত্রের মত ব্যাবহার করতে পারবে। যেমন ভেবে দেখুন, ফেসবুক চাইলে তাদের প্রত্যেক ইউজারের কনভারসেশন হিস্টোরি, তাদের রিয়ালটাইম লোকেশন এবং অ্যামাজন চাইলে তাদের ইউজারদের পারচেজ ইনফরমেশন, ক্রেডিট কার্ড ইনফরমেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, তাদের ফিজিক্যাল অ্যাড্রেস ইত্যাদি সবকিছু ট্র্যাক করতে পারবে। আর এসব ইনফরমেশন একটা দেশের একজন নাগরিক এবং এমনকি ঐ সম্পূর্ণ রিজিয়নের জন্য অনেক বেশি সেনসিটিভ। আপনি যদি এসব বিষয়ে ভালো স্টাডি করেন, তাহলে বুঝবেন যে একটা দেশের ওপরে মিলিটারি হামলা চালানোর জন্যও এইসকল ইনফরমেশন কতটা হেল্পফুল এবং সেগুলোকে কিভাবে আস্ত্রের মত কাজে লাগানো সম্ভব। কোন দেশের সাথে যদি অন্য কোন দেশ বা কোনও জাতি সাইবার ওয়ারে যেতে চায়, তখন এইসকল ইনফরমেশন তাদের কাছে সোনার খনির মত মূল্যবান হবে। তাই জনগনের ১০০% নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এসব সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিসগুলোকে একেবারে ব্যান করে দেওয়ার থেকে ভালো কোন সল্যুশন চায়নার সরকার এখনো খুঁজে পায়নি।
আর এর থেকে বড় কথা হচ্ছে, চায়নার জনগন কেন এসব শান্তভাবে মেনে নিচ্ছে? এই প্রশ্নটা আসতেই পারে কারণ আমাদের দেশে ১ মাসের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিলেই দেশের তরুনসমাজ প্রায় আন্দোলনেই নেমে যায়। কিন্তু চায়নার জনগনের এসব মেনে নেওয়ার কারণ হচ্ছে সরকারের সাথে তাদের জনগনদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং ট্রান্সপারেন্সি। চায়নার সরকার এসব সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান করেছে চায়নার জনগনদের ভালোর জন্যই। ভালোর জন্য না হলেও চায়নার জনগন এটা বিশ্বাস করে যে, এসব করার পেছনে চায়নার সরকারের অবশ্যই একটি পজিটিভ ইন্টেনশন আছে। চায়নার জনগন এবং সরকারের মধ্যে এই আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর কারনেই মূলত চায়নার মানুষের লাইফস্টাইল তথা চায়নার মানুষের অনলাইন লাইফস্টাইল পৃথিবীর অন্যান্য অনেক রিজিয়নের থেকে অনেকটা আলাদা। আর যারা তাদের সরকারের এসব ডিসিশন সাপোর্ট করেনা বা মানতে চায় না, তাদের জন্য তো ভিপিএন আছেই।
তো নিশ্চই এতক্ষনে কিছুটা হলেও ধারনা করতে পেরেছেন যে চায়নাতে কেন এসব জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম এবং ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস কেন নিষিদ্ধ। আজকের মত এখানেই শেষ করছি। আশা করি আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। কোন ধরনের প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।