শূন্য আবিষ্কার করেন কে ? শূন্যের যাত্রাপথ, ইতিহাস এবং আর্যভট্ট
শূন্য আবিষ্কারের আগে ভারতবর্ষ
শূন্য আবিষ্কার করেন কে ? (Who discovered Zero)
সংখ্যা লেখা এখন খুব সহজ কাজ। বছর ৫ -৬ এর বাচ্চারাও ০-১০ লিখে দিতে পারবে। কিন্তু আজ থেকে ৩০০ বছর আগেও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং ওশিয়ানিয়ার বহু অঞ্চলের মানুষেরা সংখ্যা লিখতে জানতেন না।
আমরা ১ থেকে ১০০ কেন হাজার বা কোটি পর্যন্ত লিখতে পারি, কিন্তু কেউ কি সঠিক ভাবে জানি এই সংখ্যা গুলি কিভাবে এলো ? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রাথমিক সংখ্যা কিন্তু ০ – ৯ অর্থাৎ ০,১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ বাকি সংখ্যা যেমন ধরুন ১০ বা ৩৪ তা কিন্তু ১,০ এবং ৩,৪ নিয়ে তৈরি।
তাই ০ -৯ সংখ্যাকে অনেকে মৌলিক সংখ্যা বলে থাকেন।
আবার অনেকে প্রশ্ন তোলেন ‘০’ কি সত্যিই কোনও সংখ্যা ? যদি আমরা ব্যাকরণের পাতা থেকে শূন্যের অর্থ খুঁজতে যাই তাহলে দেখব শূন্য মানে একটি বিন্দু।
কিন্তু অঙ্ক শাস্ত্রে শূন্য মোটেই কোনও বিন্দু নয়।
আধুনিক অঙ্ক শাস্ত্রের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে শূন্যের গুরুত্ব। লেখাটি পাঠক মন দিয়ে পড়লে তাঁর মনে আসা প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে যাবেন।
● জিরো শব্দের বুৎপত্তি
বাংলায় যা শূন্য ইংলিসে তাকে বলা হয় জিরো। এখন এই জিরো শব্দটা কিভাবে এসেছে দেখা যাক।
ভারতীয় সভ্যতার নিকটস্থ সভত্যা ছিল মেসোপটেমিয়া সভ্যতা।
মনে করা হয় সংষ্কৃতে যা শ্যুন্যেয়া তা আরব দেশে হয় সাফাইরা যার অর্থ কিছু নেই।
সেই সাফাইরা শব্দটি গ্রীস থেকে রোমে পৌছায়। অপভ্রংশ শব্দটি হয় জেফিরো। এই জেফিরো থেকেই আধুনিক ইংরেজি শব্দ জিরো এসেছে।
বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকদের অভিমত আধুনিক ইংরেজি ভাষাটা এসেছে স্যাক্সন থেকে। এই স্যাক্সন ভাষাটি এসেছে রোমান থেকে।
আবার রোমানদের সঙ্গে সংযোগ সূত্র আছে গ্রীকদের।
দ্বিতীয় আলেকজান্ডার যখন পারস্য দখল করেন তখন গ্রীস এবং পারস্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ঘটে।
দেখাই যাচ্ছে যে শ্যুন্যেয়া শব্দটি লোকমুখে উচ্চারিত হতে হতে জিরোতে পরিণত হয়েছে।
● শূন্যের মান কত ?
অঙ্ক শাস্ত্রে শূন্যের মান নেই। তবে কোনো সংখ্যার পরে অর্থাৎ ডানদিকে শূন্য বসলে তার মান বৃদ্ধি পায় তেমনি কোনো সংখ্যার আগে শূন্য বসলে তার মান অপরিবর্তিত থাকে।
উদাহরণ দিয়ে দেখানো যাক। ধরা যাক ১৮৯ সংখ্যাটির পরে আমরা দুটি শূন্য বসালাম।
এখন সংখ্যাটি হল ১৮৯০০ তার মানে অঙ্ক শাস্ত্র হিসাবে আগের সংখ্যাটির থেকে পরের সংখ্যাটি ১০০ গুণ বেশি।
কিন্তু ১৮৯ এর আগে চারটি শূন্য দিলেও তা ১৮৯ থাকবে। ১৮৯ লেখাও যা ০০০১৮৯ লেখাও তাই।
শূন্য আবার ধনাত্মক বা ঋণাত্মক নয়।
এটি কে সাহায্যকারী সংখ্যা বলা হয়। এর নিজের কোনো মান নেই তবে অন্য সংখ্যার মান শূন্যের ওপর নির্ভরশীল।
● শূন্যের আবিষ্কার
শূন্যের আবিষ্কার ঠিক কবে, কোথায় হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনীর নানা মত। তবে বহুল স্বীকৃত মত হল শূন্য আবিষ্কার হয়েছে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। এবং আবিষ্কারক হলেন আর্যভট্ট।
শূন্য আবিষ্কারের ফলে গণিত শাস্ত্র অনেক সহজ হল। দশমিক পদ্ধতিতে অঙ্ক সহজ হল। পাটীগণিত পদ্ধতিতে নির্ভুল সমাধান করা যেতে লাগল, এখন কেউ কেউ ভাববেন শূন্য সংখ্যাটি আবিষ্কারের আগে কি অঙ্ক শাস্ত্র ছিল না ?
অঙ্ক শাস্ত্র শূন্য আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই ছিল।
গণিত শব্দটি এসেছে গণনা থেকে। আগে বিভিন্ন সভ্যতায় ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যামালা ছিল। মেসোপটেমিয়া সভ্যতাতে ১ থেকে ৬০ অব্দি সংখ্যাগুলিকে বিভিন্ন অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হত।
রোমান অক্ষর দিয়ে ১, ২ লিখতে আমরা অভ্যস্থ।
১০ শব্দটি রোমান অক্ষরে লেখা হয় ‘X’ দিয়ে আবার ১১ কে লেখা হয় ‘XI’ দিয়ে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শূন্য বলে আলাদা কোনো সংখ্যা সম্পর্কে তাঁরা জানতেন না।
তেমনি গ্রিসে আল্ফা, বিটা, গামা, ডেন্টা, কাপ্পা এই শব্দগুলি দিয়ে সংখ্যা বোঝানো হত।
দশমিক পদ্ধতিতে যেমন দশের ভিত্তিতে সংখ্যা সাজানো হয় সুমের সভ্যতায় তা ছিল ৬০ এর ভিত্তিতে।
আজও আমরা ১ মিনিট = ৬০ সেকেন্ড, ৬০ মিনিটে ১ ঘন্টা হিসাব করি।
এই পদ্ধতিটি সুমের সভ্যতার। ১ থেকে ৯ এই কয়টি সংখ্যা দিয়ে আমরা হাজার হাজার সংখ্যা তৈরি করতে পারি কিন্তু শূন্যের সাহায্যে অতি সহজে আমরা লক্ষ কিংবা কোটির সংখ্যাও তৈরি করতে পারি।
শুধু তাই নয় একক, দশক, শতক এর স্থানীয় মানের অঙ্কে, দশমিকের অঙ্কে শূন্য অনেক সরলীকৃত করেছে।
অনেকে মনে করেন আর্যভট্টের বহু আগেও হিন্দু পন্ডিতবর্গ শূন্যের ব্যবহার জানতেন।
কেউ কেউ আবার বলেন পন্ডিত ব্রহ্মগুপ্ত শূন্যের আবিষ্কারক।
পিঙ্গল কর্তৃক রচিত ছন্দসূত্রে শূন্যের ব্যবহার আছে। যা খৃষ্টপূর্ব ২০০ শতকে রচিত।
আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ গাণিতজ্ঞের গণিত বইতে, বর্গমূলের অঙ্কে এবং দশমিকের অঙ্কে শূন্যের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে।
তবে সে সময় শূন্য আজকের শূন্যের রূপ পায়নি। তখন তা প্রকাশ করা হত ● চিহ্ন দিয়ে, কবে এবং কীভাবে শূন্য ‘০’ রূপ নিল তা বলা মুশকিল।
● শূন্যের যাত্রাপথ
কিভাবে এই শূন্য সংখ্যাটি সুদূর পাশ্চাত্যে পৌছালো তা এবার দেখে নেওয়া যাক। আলবেরুনীর ভ্রমনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় সে সময় ০ সংখ্যাটি লিখিত হত।
সপ্তম শতাব্দীর বিভিন্ন লিপিতেও ০ সংখ্যাটি ছিল।
মনে করা হয় ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ০ সংখ্যাটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন দুই আরবি গণিতজ্ঞ আল কিন্দির এবং আল খোয়ারিজমি। মধ্যপ্রাচ্য থেকেই সংখ্যাটি ইউরোপে প্রচলিত হয়।
আবার দেখা যাচ্ছে টলেমি ওমিক্রন বলে একটি সংখ্যার কথা তাঁর অ্যালমাজেস্ট নামক বইতে উল্লেখ করেছেন। যেটি দেখতে শূন্যের মতো।
কিন্তু গ্রীক বর্ণমালায় ওমিক্রন এর স্থান ১৫। এবং গাণিতিক ভাষায় এর মান ৭০। তাই বোঝাই যাচ্ছে দেখতে ওমিক্রন এবং শূন্য একরকম হলেও দুটি এক নয়।
ইউরোপ থেকেই শূন্য সংখ্যাটি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজি ভাষাতে জিরো শব্দটি প্রথম দেখা যায় ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি।
● শূন্য আবিষ্কারের আগে ভারতবর্ষ
ঠাকুমা, দাদু বা বয়োজ্যেষ্ঠরা এখনো একআনা, দুআনা এইভাবে হিসাব করেন। তাদের হিসাবে ১৬ আনায় এক টাকা নয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ১,২,৪,৮,১৬,৩২,৬৪ এই সংখ্যা গুলির হিসাব করা হচ্ছে।
মহেঞ্জোদারো সভত্যা তে প্রাপ্ত বাটখারা গুলি ১,২,৪,৮,১৬,৩২,৬৪,১২০২০০,৩২০,৬৪০ এই হিসাবের।
সেখানে ১৬ সংখ্যাটি সূচিত সংখ্যাগুলি ছিল বড় একক।
বৈদিক যুগে আবার কোটি সংখ্যাটির পরেও প্রযুত, অর্বুদ, সমুদ্র, অন্ত, পরার্থ শব্দগুলো পাই।
বৈদিক যুগের পরবর্তী কালে ৫৪ এবং ১৯৮ সংখ্যার সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।
তাহলে এখান থেকে বোঝাই যাচ্ছে এই সংখ্যা গুলি শূন্য ছাড়া কোনোভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
আবার কোটি সংখ্যাটি হল ১০০০০০০০ অর্থাৎ ১ এর পিছনে ৭ টি শূন্য এর পরেও সংখ্যাসূচক শব্দের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ভারতীয় উপমহাদেশে শূন্যের ব্যবহার আজকের নয়।
● আর্যভট্ট কে ?
শূন্য সংখ্যাটির ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে যে দুটি নাম উঠে আসে, তাঁরা হলেন আর্যভট্ট এবং ব্রহ্মগুপ্ত।
এখন প্রশ্ন হল এঁরা কারা ?
আর্যভট্ট বা আর্যভ হলেন বেদোত্তর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।
বর্তমানের কেরালা রাজ্যে ৪৭৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহন আরম্ভ করেন এবং শিক্ষা শেষে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন।
তাঁর জ্ঞানে গুণমুগ্ধ হয়ে সম্রাট বুদ্ধগুপ্ত তাঁকে নালন্দার প্রধান পদে নিয়োগ করেন।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি আর্যভটীয় গ্রন্থ রচনা করেন যার ৪ টি পরিচ্ছেদে ১১৮ টি শ্লোক বর্তমান।
তিনি বীজগণিত, পাটীগণিত, ত্রিকোনমিতি, জ্যামিতি, ঘাতের অঙ্ক, দ্বিঘাত সমীকরণ, প্রভৃতি পদ্ধতি এবং এই পদ্ধতিতে অঙ্ক সমাধানের উদাহরন তাঁর পুস্তকে লিখে গিয়েছেন।
আর্যভট্ট সূর্যের ব্যাস, বৃত্তের ক্ষেত্রফল, গোলকের আয়তন, ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল সংক্রান্ত অনেক তথ্য দিলেও শূন্যের আবিষ্কারক হিসাবে তিনি কতটা গ্রহনযোগ্য তা নিয়ে মতবিরোধ থাকে।
● ব্রহ্মগুপ্ত কে ?
ব্রহ্মগুপ্ত গুজরাটের ভিনমল অঞ্চলে জন্মগ্রহন করেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্ম স্ফূট সিদ্ধান্ত নামে একটি বই লেখেন।
চর্তুভুজের ক্ষেত্রফল, তল, আয়তন, ও বিভিন্ন জ্যামিতিক উপপাদ্য বিষয়ক আলোচনা তাঁর বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়।
তিনিই প্রথম গণিতজ্ঞ যিনি অঙ্ক হিসাবে শূন্যের গাণিতিক ব্যাখা করেন এবং প্রমান করে দেখান যে শূন্যের সঙ্গে কিছু যোগ বা বিয়োগ করলে আগের সংখ্যাটি অপরিবর্তিত থাকে।
আবার প্রমান করে দেখান যে কোনো সংখ্যার সঙ্গে শূন্য গুণ করলে শূন্য হয় এবং শূন্য দিয়ে কোনো সংখ্যাকে ভাগ করলে অসীম হয়।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে শূন্যের আবিস্কার বা প্রচলন যেভাবেই হোক না কেন তা যে ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রথম প্রচলিত হয় তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।
অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বকে ভারতবর্ষের অন্যতম উপহার যে শূন্য তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের শেষ কথা,,
তাহলে বন্ধুরা, আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, শূন্য আবিষ্কার করেন কে এবং এছাড়া ব্রহ্মগুপ্ত কে ? এবং আর্যভট্ট কে ?, সেই বিষয়েও বিস্তারিত ভাবে জানতে পারলাম।
শূন্যের ইতিহাস এবং আবিষ্কার নিয়ে লিখা আমাদের আজকের আর্টিকেল যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশই আমাদের আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে, নিচে কমেন্ট করে অবশই জানাবেন।