ভারতজুড়ে বিভিন্ন ছোট বড় দেশ গুলোতে আজ সফটওয়্যার পাইরেসি হল একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা।
বর্তমানে একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, ভারতে সফটওয়্যার পাইরেসির হার প্রায় ৭৩ শতাংশ।
যা, নিঃসন্দেহে অনেকটাই বেশি।
অসাধুভাবে আসল সফটওয়্যারের বেআইনি সংস্করণ তৈরী ও তার ব্যবহারকে সাধারণ অর্থে আমরা সফটওয়্যার পাইরেসি বলে জেনে থাকি।
আর, আজকে আমাদের এই আর্টিকেলের আলোচনার মূল বিষয়ই হল এই সফটওয়্যার পাইরেসি বলতে কি বুঝায় এবিষয়ে।
আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় এই সফটওয়্যার পাইরেসি শব্দটি কোনো না কোনো সময় অবশই শুনেছি, কিন্তু এই বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান হয়তো আমাদের এখনো নেই।
তাই, কি কি ধরণের সফটওয়্যার পাইরেসি হতে পারে ও এই পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে কি কি বিপদ দেখা দিতে পারে এই সম্পূর্ণ বিষয়ে আমরা জানবো।
প্রথমেই চলুন আমরা জেনে নিই, আসলে কি এই সফ্টওয়্যার পাইরেসি ?
সফটওয়্যার পাইরেসি কি – (What Is Software Piracy)
আসলে, যেসব সফটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার বা নির্মাতা রয়েছে, তারা আইনতভাবে তাদের প্রোডাক্ট বা সফটওয়্যার তৈরী করে থাকে এবং সেগুলো বাজারে সরবরাহ (supply) করে থাকে।
এইবার ব্যাপার হল, যখন কোনো আইনতভাবে তৈরী সফটওয়্যারের লাইসেন্স চুক্তিতে বলা অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো অসৎ উপায়ে যদি সেই সফ্টওয়্যারের অবৈধ অনুলিপি, ইনস্টলেশন, ব্যবহার, বিতরণ বা বিক্রয় করা হয়, তখনই সেই বেআইনি উপায়গুলো সফটওয়্যার পাইরেসি বলে বিবেচিত হয়।
সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ইনস্টল করা প্রায় ৩৭% সফ্টওয়্যার হল বেআইনি বা লাইসেন্সবিহীন সফ্টওয়্যার।
এই পাইরেসি বা বেআইনি ব্যবহারের ফলে সফটওয়্যার শিল্প ও কোম্পনিগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চলেছে।
এই সফ্টওয়্যার পাইরেসি সাধারণত শেষ ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি ডিলারদের দ্বারাও পরিচালিত হয়।
আর, এই পাইরেসির জন্য কোনো দক্ষ হ্যাকার বা কোডারের প্রয়োজন পড়ে না।
কোনো ব্যক্তি যদি সফটওয়্যার আইন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন, তবে তিনি অনেক সময়ই সাধারণ ভাবে কম্পিউটার ব্যবহারের সময়, নিজের অজান্তেই একজন সফটওয়্যার পাইরেট বা সফটওয়্যার জালিয়াতে পরিণত হয়ে যেতে পারেন।
তাই, এইরকম ক্ষতিকারক, বেআইনি অপরাধ থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত করতে এইসব পাইরেসিগুলোর সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিতভাবে জানা উচিত।
সফটওয়্যার পাইরেসির সংজ্ঞা – (Definition of software piracy)
সফ্টওয়্যার পাইরেসি হল আইনত সুরক্ষিত সফটওয়্যার গুলোকে বেআইনিভাবে চুরি করা।
এই চুরির মধ্যে পড়ে সফ্টওয়্যারের কপি বা অনুলিপি তৈরী করা, বিতরণ করা, পরিবর্তন করা কিংবা অসৎ উপায়ে বিক্রি করা।
এই সফটওয়্যার গুলোকে সুরক্ষিত করতে নানা ধরণের কপিরাইট আইন তৈরী করা হয়েছে, যাতে সফ্টওয়্যার ডেভেলপার বা নির্মাণকারীরা (প্রোগ্রামার, রাইটার, গ্রাফিক ডিসাইনার প্রমুখ) তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য, সম্মান এবং পারিশ্রমিক পান।
আর, যখন এই সফটওয়্যার পাইরেসি করা হয়, তখনই এই কপিরাইট অধিকারীদের অর্থাৎ নির্মাণকারীদের তাদের যথাযথ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
পাইরেটেড সফ্টওয়্যার বিক্রি করে পাইরেট বা অপরাধীরা অনায়াসেই প্রচুর সুবিধা লাভ করে থাকে অথচ যারা প্রচুর টাকা ও পরিশ্রম ব্যয় করে সফটওয়্যারটি তৈরী করেন তাদের তো বটেই বরং সমস্ত সফ্টওয়্যার শিল্পের ব্যবসাও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
আর, জাল সফটওয়্যার গুলো পাইরেটেড সফটওয়্যার বলে পরিচিত।
সফটওয়্যার পাইরেসির ধরণ-ধারণ:
পাইরেসি বিভিন্ন উপায়ে করা হয়ে থাকে।
যেমন – হার্ড-ডিস্ক লোডিং, কাউন্টারফেইটিং, সফটলিফটিং, সফ্টওয়্যার ভাড়া দেওয়া এবং বুলেটিন বোর্ড পাইরেসি ও ইত্যাদি।
প্রকৃত লাইসেন্সধারী সফ্টওয়্যার গুলো ব্যবহারকারী বা গ্রাহকদের জন্য অনেকগুলো মূল্যবান সুবিধা প্রদান করে,
যেমন- আপগ্রেড করার অপসন, উন্নতমানের কোয়ালিটি এবং রিলায়েবিলিটি নিশ্চিত করা, প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া ও ইত্যাদি।
এমনকি, কোনো কোম্পানি যদি পাইরেটেড সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে, তবে তাদের বিশাল আর্থিক ও আইনত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
এছাড়া, পাইরেটেড সফ্টওয়্যার ব্যবহার করলে উপরে উল্লেখিত কোনো সুবিধাই তারা গ্রাহকদের প্রদান করতে পারেনা।
এবং দেখা গেছে যে অনেক পাইরেটেড সফটওয়্যার গুলো ফ্রীতে বিতরণ করে সেগুলোর মাধ্যমে ভাইরাস, অ্যাডওয়্যার ইত্যাদি ছড়ানো হয়।
সফটওয়্যার পাইরেসির প্রকার
মূলত, পাঁচটি প্রধান ধরনের সফটওয়্যার পাইরেসি দেখা যায়।
এই ধরনের পাইরেটিং কৌশল গুলো ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে, কি করে একজন মানুষের ইচ্ছাকৃত অপরাধের সাথে অন্যরা তাদের অজান্তে সেই ব্যক্তির সংঘটিত অপরাধের শিকার হয়।
১. সফটলিফটিং:
যখন কেউ একটি মাত্র সফটওয়্যারের সংস্করণ ক্রয় করেন এবং সেটি একাধিক কম্পিউটারে ডাউনলোড করেন, তখন এই ধরণের পাইরেসিকে সফটলিফটিং বলে চিহ্নিত করা হয়।
তবে, সফ্টওয়্যার লাইসেন্সে বলা হয় যে, সফটওয়্যারের একটিমাত্র সংস্করণ শুধুমাত্র একবারই ডাউনলোড করা উচিত।
এই ধরণের সফটলিফটিং অপরাধ গুলো প্রায়শই স্কুল বা কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে করা হয়ে থাকে।
এই সবচেয়ে সাধারণ ধরনের সফটওয়্যার পাইরেসি প্রধানত অর্থ বাঁচানোর জন্যই করা হয়ে থাকে।
২. ক্লায়েন্ট সার্ভারের অতিরিক্ত ব্যবহার:
ক্লায়েন্ট-সার্ভার ব্যবস্থার অত্যধিক ব্যবহারও হল একধরণের প্রাইভেসি।
যখন একটি নেটওয়ার্কে অনেক মানুষ একই সময়ে প্রোগ্রামের একটি প্রধান অনুলিপি ব্যবহার করে,
তখনই এই ধরণের পাইরেসি ঘটতে পারে।
মূলত, যখন ব্যবসাগুলো একটা লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কের অধীনে থাকে এবং সমস্ত কর্মীদের ব্যবহারের জন্য একই সফ্টওয়্যার বারবার বিভিন্ন কম্পিউটারে ডাউনলোড করে, তখনই সেটা সফটওয়্যারের বেআইনি ব্যবহার হিসেবে মনে করা হয়।
(অবশ্যই যদি লাইসেন্স আপনাকে এই সফটওয়্যারটি একাধিকবার ব্যবহার করার অধিকার না দেয় তো।)
৩. হার্ড ডিস্ক লোডিং:
হার্ড ডিস্ক লোডিং হল এক ধরনের বাণিজ্যিক সফ্টওয়্যার পাইরেসি।
এতে কেউ সফ্টওয়্যারটির একটি আইনি সংস্করণ কিনে নেন আর তারপর কম্পিউটার হার্ড ডিস্কে যতবার ইচ্ছে পুনরুৎপাদন বা জেনারেট করেন, কপি করেন বা ইনস্টল করেন কিংবা তারপর সেই সফটওয়্যারের বেআইনি সংস্করণগুলো বিক্রি করেন।
তখনই তা হয়ে যায় হার্ড ডিস্ক লোডিং পাইরেসি।
এই ঘটনা প্রায়ই PC রিসেলিং করার দোকানে ঘটে এবং অসেচতন ক্রেতারা বেশিরভাগই অবৈধভাবে নিজেদের অজান্তে সেইসব পাইরেটেড সফ্টওয়্যার কিনে থাকেন।
৪. জালিয়াতি বা কাউন্টারফেইটিং:
যখন সফ্টওয়্যার প্রোগ্রামগুলো অবৈধভাবে নকল করা হয় এবং অথেন্টিসিটির নাম করে নকল সংস্করণ বিক্রি হয়, তখন তাকে সফটওয়্যার কাউন্টারফেইটিং বা জালিয়াতি বলে।
জাল সফ্টওয়্যারগুলো অনেক সময়ই বৈধ সফ্টওয়্যারের তুলনায় অনেকটা কম মূল্যে মার্কেটে বিক্রি করা হয়।
৫. ইন্টারনেট পাইরেসি:
ইন্টারনেট পাইরেসি বা অনলাইন পাইরেসি হল যখন বেআইনি, লাইসেন্সবিহীন সফ্টওয়্যার ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিক্রি বা কেনা হয়।
এই পাইরেসি সাধারণত একটা পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) ফাইল-শেয়ারিং ব্যবস্থার মাধ্যমে করা হয়, যা বিভিন্ন অনলাইন নিলাম সাইট এবং ব্লগের আকারে দেওয়া থাকে।
সফটওয়্যার পাইরেসির বিপদ সমূহ:
সফ্টওয়্যার পাইরেসি অনেক অসৎ উপায়ে রোজগারের পথ করে দিলেও, আসলেই এটি অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আর এর ফলে দেখা দিতে পারে সমূহ বিপদ, সেগুলো হল –
১. সফ্টওয়্যারটির ত্রুটির পরিমাণ বেড়ে যায় কিংবা অনেক সময়ই তা কাজ করতে ব্যর্থ হয়।
২. নকল সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে প্রি-লোডেড ট্রেনিং, আপগ্রেডস, কাস্টমার সাপোর্ট এবং বাগ ফিক্সিং-এর মতো মূল্যবান ও সহায়তাকারী প্রোগ্রামগুলোর অ্যাক্সেস কেড়ে নেওয়া হয়।
যা সফটওয়্যার ব্যবহার করার সময় একজন গ্রাহকের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৩. জাল সফটওয়্যারে কোনোরকম ওয়ারেন্টি থাকে না এবং কোনো ধরণের কোম্পানির দেওয়া সফ্টওয়্যার আপডেটও করা যায় না।
৪. অ্যাডওয়্যার, ম্যালওয়্যার, ভাইরাসের মতো ক্ষতিকারক প্রোগ্রামগুলো জাল সফটওয়্যারের সাথে চলে আসে।
যা আপনার কম্পিউটারকে সংক্রামিত করে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
৫. বেআইনি সফটওয়্যার আপনার কম্পিউটার সিস্টেমকে স্লো বা শ্লথ করে দিতে পারে।
৬. কপিরাইট উল্লঙ্ঘন করে আপনি অজান্তেই কোনো আইনি জালে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারেন।
তাই, নিজের কম্পিউটার সিস্টেমকে সুরক্ষিত রাখতে অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকেই সফটওয়্যার কিনুন।
যেকোনো সফ্টওয়্যারের শর্তাবলীর সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকুন।
আর, সফটওয়্যার ইন্সটলেশনের সময় সমস্ত শর্তাবলী ভালো করে পড়ুন এবং সেই অনুযায়ী অনুমতি প্রদান করুন।
আপনার ডিভাইসকে সুরক্ষিত রাখতে অবশ্যই আসল অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন, যা আপনার ডিভাইসকে সফটওয়্যার পাইরেসি থেকে শুরু করে যেকোনো থ্রেট বা হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারবে।
আমাদের শেষ কথা,,
সফটওয়্যার পাইরেসি নিয়ে লেখা আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
আশা করছি, সফটওয়্যার পাইরেসি বলতে কি বুঝায় বা কাকে বলে, এই বিষয়ে আপনাদের সম্পূর্ণ এবং স্পষ্ট জ্ঞান অবশই হয়ে গেছে।
আমাদের আজকের লেখাটি পছন্দ হলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করতে কিন্তু ভুলবেননা।