অহংকার কাকে বলে ? অহংকার কি ? এবং অহংকারী মানুষ চেনার ৫টি উপায় জেনেনিন।
আমরা চিরকাল জেনে এসেছি, যে ‘অহংকারই পতনের মূল কারণ’।
আর, পুরাণ কথা অনুসারে, লঙ্কার রাজা রাবণের পতনের মূল কারণই ছিল তাঁর দম্ভ বা অহংকার, যা লংকার পরাজয়ের প্রধান কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছিল।
আসলে, আমরা আমাদের আশেপাশে এই ‘অহংকার’ বা ‘অহংকারী’ শব্দ দুটি প্রায়ই শুনে থাকি।
তবে, আসলেই অহংকার কি বা এই অহংকারের অনুভূতি কি ধরণের হয়ে থাকে ?
তাই, আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে বুঝবো, যে এই অহংকার কি বা কি কি ধরণের অহংকারের প্রকার আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখে থাকি সেই সব বিষয়েও আলোচনা করবো।
চলুন, প্রথমে জানা যাক, এই অহংকারের সংজ্ঞা কি ? বা অহংকার বলতে কি বুঝায়।
অহংকার কি ?
আসলে, এই অহংকার বা দম্ভ হল যেকোনো ব্যক্তির মনে পালিত এক ধরণের অতিমাত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব।
যেই মনোভাবের মাধ্যমে কোনো মানুষ অপ্রীতিকরভাবে গর্বিত অনুভব করেন আর এমন ধরণের আচরণ করেন; যাতে মনে হয়, যে অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় সেই ব্যক্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা বেশি জ্ঞানের অধিকারী।
অহংকারের সংজ্ঞা হল, যখন কোনো ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, যে তিনি অন্যদের থেকে সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠ আর অন্য সবার থেকে তিনি বেশি জানেন কিংবা, সেই ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, যে তিনি এমন কিছু করতে সক্ষম যা আসলেই অন্য কারোর পক্ষেও করা অসম্ভব।
আর, যাদের মনে এই অহংকারের প্রবৃত্তি থাকে, তাদেরকে আমরা সাধারণ ভাষায় অহংকারী বা দাম্ভিক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি।
সুতরাং, এখন জানা যাক, কারা এই অহংকারী ?
যে ব্যক্তি অহংকারী হন, তিনি অন্য ব্যক্তিদের সামনে অতিমাত্রায় গর্বিত ও অপ্রীতিকর আচরণ করে থাকেন।
কারণ, অহংকারী ব্যক্তিরা মনে করেন, যে অন্যদের চেয়ে তিনি অনেকটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে বুঝলেন তো, অহংকার কাকে বলে ?
অহংকার কত প্রকার:
মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায়, তাঁরা অহংকারের প্রধান তিন ধরণের প্রকার খুঁজে পেয়েছেন; সেগুলো হল –
১. ব্যক্তিগত অহংকার (Individual arrogance):
এই ধরণের অহংকারের প্রকার হল সবচেয়ে বেশি পরিচিত ধরণের দম্ভ বোধ।
এটি হল নিজের ক্ষমতা বা কৃতিত্বের দ্বারা অর্জিত সাফল্যের উপর পোষণ করা অতিরঞ্জিত মতামতের বহিঃপ্রকাশ।
যেকোনো ব্যক্তিই কম-বেশি নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতি, যেমন- প্রমোশন পাওয়া বা অপ্রত্যাশিত ধনপ্রাপ্তির জন্যে গর্ববোধ করেন।
এই ধরণের অহংকার বোধ করা অতি সাধারণ ও বিরক্তিকর ব্যাপার হলেও এটি একেবারেই ক্ষতিকারক নয়।
সোজা কথায় বলতে গেলে,
এই ধরণের অহংকারী ব্যক্তিরা সাধারণত বাস্তবের তুলনায় একটু বেশিই নিজের ক্ষমতা, বৈশিষ্ট্য বা কৃতিত্বের প্রতি এক ধরণের অতিরঞ্জিত মনোভাব পোষণ করেন।
২. প্রতিযোগিতামূলক অহংকার (Competitive arrogance):
এই প্রকারের অহংকারী ধরণের মানুষদের, অন্যদের তুলনায় তাদের নিজস্ব ক্ষমতা বা কৃতিত্বের উপর এক ধরণের অতিমাত্রিক অহংকারবোধ রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,
এই প্রকারের অহংকারে যারা অন্ধ থাকেন, তারা মনে করেন যে, তারা যেকোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের কাজের তুলনায় অনেক বেশি শ্রেষ্ঠ কাজ করতে সক্ষম।
অর্থাৎ, এই ধরণের ঔদ্ধত্যের প্রকারে মানুষ অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় নিজেকে অনেক বেশি যোগ্য, শ্রেষ্ঠ ও কর্তৃত্ব স্থাপনের যোগ্য হিসেবে মনে করেন।
৩. বিরোধী অহংকার (Antagonistic arrogance):
সম্ভবত, এই ধরনের অহংকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক।
এই ধরণের অহংকারে ব্যক্তি নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অনুমানের ভিত্তিতে অন্য মানুষদের অবমাননা করেন আর সেই অবমাননার বিষয়টাকে উপভোগ করেন।
একজন বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন অহংকারী ব্যক্তি অন্যদের প্রতি আপনাকে “সক্রিয় বিরোধিতা বা শত্রুতা” দেখাতে বা অনুভব করাতে আগ্রাসনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এই ধরণের অহংকারবোধ মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের অনুমানের উপর নির্ভর করে অন্যদেরকে অবজ্ঞা করতে অনুপ্রাণিত করে।
অহংকারী মানুষের কি কি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে ?
- একজন দাম্ভিক ব্যক্তি মূলত বিশ্বাস করেন, যে তিনিই ভালো, তীক্ষ্ণ ও অন্যদের তুলনায় অনেকটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
- একজন অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে শ্রেষ্ঠতর, অদম্য, অভিমানী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন।
- অন্যদের সময়, বিশ্বাস, বা ধারণার চেয়ে একজন দাম্ভিক ব্যক্তি নিজের সময়, বিশ্বাস, বা ধারণাকে অধিক মূল্য দিয়ে থাকেন।
- সেই ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে, তিনি তার নিজের কাছে কী আছে বা তিনি কী করতে পারেন, তা অতিরিক্ত মাত্রায় প্রদর্শন করে থাকেন।
অর্থাৎ, তিনি অন্যদেরকে নিচুতে রেখে নিজে ভালো বোধ করার চেষ্টা করেন।
এই ধরণের অহংকার বোধ গুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেকোনো মুহূর্তে জন্ম নিতে পারে।
আর, খুব সাধারণভাবেই আমাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে অহংকার প্রদর্শন করেই থাকি।
এমনকি, সেই অহংকার প্রদর্শন ছোট আকারের হলেও, সেখানে নামমাত্র অহংকারের প্রকাশ সবসময়েই থেকেই যায়।
অথচ, খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা অন্যের মধ্যে থাকা অহংকারকে অবিশ্বাস্যভাবে অনাকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করে থাকি।
অহংকারী মানুষ চেনার ৫টি উপায়:
মানুষের জীবনে একজন অহকারী মানুষের সান্নিধ্য একেবারেই অবাঞ্চিত ও বিরক্তিকর।
তাই, আপনার জীবনে একজন অহংকারী মানুষ থাকলে, তা আপনার জীবনে অশান্তি ডেকে আনতে পারে।
যদিও, আত্মবিশ্বাস একদিকে আর অহংকার একদিকে।
তাই, আপনার উচিত এইসব মানুষদের চিনে নিয়ে নিজেকে এদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা।
তাই, এই আর্টিকেল থেকে জেনে নিন, অহংকারী মানুষ চেনার সহজ পাঁচটি উপায় সম্পর্কে –
১. বড়াই করা:
অত্যধিক বড়াই করা একজন অহংকারী ব্যক্তির সবচেয়ে সুস্পষ্ট লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি।
কোনো বস্তুগত সম্পদ হোক কিংবা মর্যাদা বা নির্দিষ্ট কোনো কিছুই অর্জনই হোক না কেন, তারা সবসময় আপনাকে আগ বাড়িয়ে জানাতে চান, আর, তারা তাদের জীবনে কতটা সফলতা পাচ্ছেন বা কত বিশাল কিছু অর্জন করছেন, সেই বিষয়েও বড়াই করতে ছাড়েন না।
আপনি লক্ষ্য করতে পারেন, যে আপনি যদি কোনো ধরণের সফলতার উদযাপন করেন, তবে একজন অহংকারী ব্যক্তি আপনাকে অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে আপনার সাথে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবহার করেন।
সেই সব ব্যক্তিরা সবসময়েই তাদের নিজেদের কৃতিত্ব বা জীবনের জয় নিয়ে আনন্দ করার জন্য তাদের নিজেদের দিকে ফোকাস নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
২. অশালীন ব্যবহার করা:
অহংকারবোধ মানুষের মনে প্রায়শই অন্যের উপরে চাপ প্রয়োগের মনোভাব তৈরী করে দেয়।
যার কারণে, একজন অহংকারী মানুষ সামাজিক ব্যবস্থায় অবিশ্বাস্যভাবে অশালীন আচরণ করতে পারেন।
তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যে তারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাই, তাদের অন্য মানুষের অনুভূতি বা চাহিদা সম্পর্কে বিবেচনা করার বুদ্ধির অভাব থাকে।
আর, যেভাবেই হোক তারা সবসময় নিজেদের প্রথম স্থানে রাখতে ভালোবাসেন।
এই ধরণের একরোখা ও স্বার্থপর ব্যবহারের কারণে অনেকের কাছেই তারা অসভ্য মানসিকতার মানুষ হয়ে ওঠেন।
আপনি খেয়াল করে দেখবেন, যে অহংকারী লোকেদের মধ্যে মানুষকে নিকৃষ্ট ও নগন্য প্রমাণ করার প্রবণতা থাকে।
তাই, তারা সর্বদা তাদের যোগ্যতার নিচে থাকা ব্যক্তিদের সাথে অশালীন ও অপমানজনক ব্যবহার করে থাকেন।
৩. তারা নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত মনোভাব পোষণ করেন:
একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, ‘যে বুদ্ধিমানরা সন্দেহে ভরপুর থাকে আর মূর্খরা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকে’।
অর্থাৎ, একজন অহংকারী ব্যক্তি তার সামর্থ্যকে অতিরিক্ত মাত্রায় মূল্যায়ন করে থাকেন।
প্রাথমিকভাবে, একজন অহংকারী ব্যক্তি তার মসৃণ কথা বলার ধরণের সাহায্যে অনেক ভাল চাকরি বা ক্ষমতার পদে আসীন হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
যদিও, তাদের নিজস্ব ক্ষমতার উপর জন্মানো এই ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত যখন ভেঙে যায়, তখন তারা তাদের আসল যোগ্যতার প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন।
৪. তারা মনে করেন, যে তারা সবসময়েই সঠিক:
আপনার বিপদে একজন অহংকারী ব্যক্তির সাথে সবসময়েই একমত হবেন, কারণ তারা নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে যেকোনো কাজ করতে পারেন।
কারণ, তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে, অতি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর বিষয়েও নিজের ধারণাকে সঠিক বলে প্রমাণিত করা।
আর, কখনোই কোনো যুক্তিকে হাতছাড়া না করা আর তাদের মতামত ও বিশ্বাসকে প্রচণ্ডভাবে রক্ষা করাই হল তাদের চরম অহংকারবোধের প্রধান লক্ষণ।
তারা প্রায়শই স্বাধীন মানসিকতার পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট ভাবধারা নিয়ে চলেন, যা তাদের অন্যান্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিবেচনা করা থেকে বিরত রাখে।
৫. তারা রক্ষণাত্মক ব্যবহার করেন:
একজন অহংকারী ব্যক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ বা সমালোচনা হল তাদের অহংবোধের জন্যে খুবই মারাত্মক একটা ব্যাপার।
তাই, কোনো রকম কোনো জটিল সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে, যেকোনো অহংকারী মানুষ অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিরক্ষামূলক হয়ে ওঠেন।
এর কারণ হল, প্রকৃতপক্ষে তারা মানসিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বা তারা কোনো অনুভূত হুমকি থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকেন।
কখনও কখনও সেই রক্ষণাত্মক মনোভাব মতামতের পার্থক্য বা কিছু বিষয়ে ভুল প্রমাণিত হওয়ার মতো সামান্য ঘটনা থেকেও শুরু হতে পারে।
পরিশেষে:
একজন অহংকারী মানুষ সবসময় নিজেকে কেন্দ্র করে বাঁচতে ভালোবাসেন আর অনেকসময়ই অপর ব্যক্তিকে হীনমন্য বোধ করতে আস্কারাও দিয়ে থাকেন।
তাঁদের আত্মানুরাগ এতটাই বেশি থাকে, যে তাদের মধ্যে সহমর্মিতার মনোভাব থাকে না বললেই চলে।
যা তাদের একজন হৃদয়হীন ও অশালীন মানুষ হিসেবে পরিণত করে তোলে।
তবে, তারা অনেক সময়েই বুঝতে অক্ষম হন, যে কোনো মানুষকে ছোট করে কখনওই নিজেকে বড় প্রমাণিত করা যায় না।
আর, আমাদের আজকের ‘অহংকার কাকে বলে‘ এবং ‘অহংকারী মানুষ চেনার উপায় কি‘, বিষয়টি নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
লেখাটি পছন্দ হলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।