টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন, অতিত বর্তমান ভবিষ্যৎ
টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি এর ভবিষ্যৎ
টাচস্ক্রীন এমন এক প্রযুক্তি যা আজকের দিনে প্রায় সকল ডিভাইজেই লক্ষ করা যায়। সে আপনার স্মার্টফোন হোক আর ট্যাবলেট হোক আর স্মার্ট ওয়াচ ই হোক না কেনো। এবং এটি এমন এক প্রযুক্তি যেটা ছাড়া আমরা স্মার্ট ডিভাইজ গুলো কল্পনায় করতে পারি না। কল্পনা করুন বাজারে নতুন এক স্মার্টফোন আসলো, তাতে ১০ জিবি র্যাম আছে, ৫০০ জিবি মেমোরি আছে আর আছে ৫০ মেগাপিক্সেলস ক্যামেরা। কিন্তু ফোনটিতে টাচস্ক্রীন নেই। এখন সৎভাবে আমাকে বলুন, আপনি কি ফোনটি কিনবেন? বা ফোনটির প্রতি আকর্ষিত হবেন? থাক! আর বলতে হবে না, উত্তর আমার জানা আছে। যাই হোক আজকের এই পোস্ট এ আমি টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি। আজ জানবেন এই প্রযুক্তি কি, এটা অতিতে কেমন ছিল, বর্তমান এ কি কি আছে, এবং সামনের দিনে এই প্রযুক্তির কি কি উন্নতি হতে পারে তা নিয়ে।
প্রথমেই এই প্রযুক্তির প্রকার ভেদ সম্পর্কে জানা যাক। এতদিনে আপনি যতো গুলো টাচস্ক্রীন এর সম্মক্ষিন হয়েছেন তা হয়তো ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন অথবা রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন। এছাড়াও এই প্রযুক্তির আরো অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। কিন্তু আজকের এই পোস্ট এ আমি শুধু ক্যাপাসেটিভ এবং রেজিসটিভ নিয়ে আলোচনা করবো।
রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি
আমরা আগের দিনে যে টাচস্ক্রীন ব্যবহার করতাম তা হলো রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন। যেসব পুরাতন ফোন ছিল যেমন নোকিয়া, সনি, এইচটিসি ইত্যাদি এতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো। এটি অনেক পুরাতন একটি প্রযুক্তি। আপনারা হয়তো লক্ষ করে থাকবেন যে আগের টাচস্ক্রীন ফোন গুলোর সাথে একটা লম্বা লাঠি থাকতো, এবং এটি দিয়ে গুতিয়ে কাজ করতে হতো। এই প্রযুক্তি মোবাইলফোন এ ব্যবহার করা এক হয়রানির ব্যাপার ছিল। যখন নতুন নতুন টাচস্ক্রীন ফিচার বাজারে এসেছিলো তখন অনেকেই বলতেন যে এটি একটি বেকার প্রযুক্তি, এরচেয়ে বাটন ওয়ালা ফোনই অনেক ভালো। বাস্তবিক ভাবে দেখতে গেলে তারা ঠিকই বলতেন। কেনোনা তখন যে টাচস্ক্রীন পাওয়া যেতো তা এতোটাই খারাপ ছিল যে ফোনকে স্থির করে ধরে তারপর প্ল্যাস্টিক লাঠি দিয়ে চেপে গুতিয়ে গুতিয়ে কাজ করতে হতো। কখনো কাজ করত আবার কখনো কাজ করত না। তাছাড়াও দেখা যেতো যে টাচ করার ১ সেকেন্ড পরে কাজ করছে।
রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন এ দুইটি লেয়ার থাকে। একটি ট্রান্সপারেন্ট লেয়ার যেটি নিচে থাকে তাকে বলা হয় কন্ডাক্টিভ লেয়ার। এবং এই লেয়ার এর উপরে আরেকটি লেয়ার থাকে জাকে বলা হয় নরমাল লেয়ার। কন্ডাক্টিভ লেয়ার এবং নরমাল লেয়ার এর মাঝে হালকা ফাকা স্থান থাকে। যখন আপনি যেকোনো বস্তু দিয়ে স্ক্রীনে টাচ করেন তখন এই লেয়ার দুইটি একে অপরের সংযোগে আসে। এবং যে পয়েন্টে সংযোগে আসে সেই পয়েন্টে একপ্রকার রোধ এর পরিবর্তন ঘটে। স্ক্রীনের যে চার কোনা থাকে তার মাধ্যমে রেজিসটিভ টাচস্ক্রীনটি বুঝতে পারে যে ব্যবহারকারী ঠিক কোন অংশে স্ক্রীনটীকে টাচ করেছে। তারপর যেই পয়েন্ট এ কি মেনু ছিল তা সফটওয়্যার এর মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।
রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি অনেক পুরাতন, এটি বেশি পাওয়ার ক্ষয় করে, এর টাচ প্রযুক্তি তেমন একটা নির্দিষ্ট নয়, এটি দ্রুত কাজ করতে পারে না। এটি ব্যবহার করার জন্য আপনাকে অনেক জোড়ে জোড়ে চাপতে হতে পারে। যেকোনো বস্তুর চাপ লেগেই এই স্ক্রীন কাজ করে ফেলতে পারে। আর এই জন্যই আজকের দিনে আধুনিক স্মার্টফোন গুলোতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না। তারপরও এর ব্যবহার আজকের দিনেও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন এখনো এটিএম মেশিনে এই টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এমন কোনো ডিভাইজ যেখানে জনগন এসে টাচ করে, আপনি জানেন না যে মানুষ কি দিয়ে টাচ করবে। সে পেন ব্যবহার করতে পারে বা শীতের সময় হাতে মুজা পরে থাকতে পারে, এরকম অবস্থায় রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন ব্যবহার করায় শ্রেয়। কেনোনা এই স্ক্রীন এ কাজ করার জন্য আপনাকে শুধু মাত্র একটি বস্তুর দরকার পরে। আপনি যা ইচ্ছা সেই বস্তু দিয়ে টাচ করতে পারেন। তাছাড়া রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন গরম, শীত সকল মৌসুমেই কাজ করে, প্রকৃতির কোনো ফলাফল এর উপর পরে না। তাছাড়া এটিএম মেশিন গুলোতে তেমন একটা নির্দিষ্ট টাচ এর প্রয়োজন পরে না। সেখানে অনেক বড় বড় আইকন এর মেন্যু দেখতে পাওয়া যায় যার জন্য টাচ মিস হয় না।
ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি
এই টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি সম্পূর্ণই আলাদা। মানব দেহ অনেকটা ব্যাটারির মতো কাজ করে থাকে। আমরা কনো বস্তুকে স্পর্শ করে এক চার্জ অনুভব করতে পারি এবং বস্তুটিকেও এক চার্জ দিতে পারি। সুতরাং মানব দেহ চার্জ সুপরিবাহী। ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন এর যে লেয়ারটি থাকে সেটিও একপ্রকার পরিবাহী লেয়ার। সুতরাং যখন ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন এ টাচ করা হয়ে থাকে তখন এর লেয়ার এর ক্যাপ্যাসিট্যান্স এর পরিবর্তন ঘটে এবং স্ক্রীনটি বুঝতে পারে যে ঠিক কোন পয়েন্ট এ টাচ করা হয়েছে। এবং ঠিক একই ভাবে সফটওয়্যার এর সাহায্যে মেন্যু অপশন এ কাজ করে, এবং আপনি তা বুঝতে পারেন। এই প্রযুক্তি অনেক অগ্রসর একটি প্রযুক্তি এবং এর ব্যবহার করাও অনেক সহজ। এটি অনেক দ্রুত কাজ করে।
কিন্তু ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন এর একটি অসুবিধা হলো এটি শুধু মাত্র আপনার হাত দিয়েই কাজ করে। কেনোনা এটি শুধু মাত্র পরিবাহী থেকে রেসপন্স পায় এবং এমন পরিবাহি হতে হবে যেটি নিজে চার্জ গ্রহন করে এবং হালকা চার্জ প্রদান করে। আজকাল বাজারে অনেক আধুনিক ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন আসছে, যেগুলো অনেক বেশি সেন্সিটিভ। যার ফলে আপনি হালকা গ্লপ্স পরিধান করেও টাচ করতে পারবেন। তারপরেও ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন রেজিসটিভ টাচস্ক্রীন এর মতো যেকোনো বস্তুর স্পর্শেই কাজ করার ক্ষমতা রাখে না।ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা অন্যান্য কম্পিউটিং ডিভাইজ গুলোর জন্যই ভালো। কিন্তু পাবলিক ডিভাইজ গুলোর জন্য আমার মতে রেজিসটিভ টাচস্ক্রীনই ভালো। কেনোনা আপনি জানেন না যে মানুষ কি ব্যবহার করে টাচ করবে।
টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি এর ভবিষ্যৎ
তো এতো গেলো রেজিসটিভ এবং ক্যাপাসেটিভ টাচস্ক্রীন প্রযুক্তির কথা। কিন্তু সামনের দিনে কি ধরনের টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি দেখতে পাওয়া যেতে পারে? এর ভেতর কি উন্নত ফিচার থাকবে? তো ভবিষ্যতে যে টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি আসবে তা আজকের দিনের টাচস্ক্রীন থেকে অনেক আলাদা এবং অগ্রসর হতে পারে। হয়তো এমনটা হতে পারে যে আপনি স্ক্রীন এ একটি নরম বস্তুর ফটো দেখছেন এবং আপনার হাতেও নরম অনুভব হচ্ছে, অথবা একটি পাথর এর ফটোকে ছুলে আপনার হতেও শক্ত কিছু অনুভূত হচ্ছে। তাছাড়াও এমন কনো প্রযুক্তিও আসতে পারে যেখানে আপনি আলট্রাসনিক ওয়েভস এর মাধ্যমে হাওয়ার উপর কাজ করে স্ক্রীন এ টাচ করতে পারবেন। যেটা কিনা আইরন ম্যান কিংবা এক্স ম্যান মুভিতেই দেখা গেছে এই পর্যন্ত।
তবে এই কথাটি কিন্তু একদম সত্য যে অদূর ভবিষ্যতে অনেক উন্নত প্রযুক্তির টাচস্ক্রীন হয়তো আমরা দেখতে পাব। অনেক বড় বড় কোম্পানি নতুন টাচস্ক্রীন প্রযুক্তি এর উপর অনেক বছর ধরে গবেষণা করে আসছে। সামনের ৫-৬ বছরে হয়তো সেই প্রযুক্তির দর্শন পেলেও পেতে পারি। আমারা যেটা আজ পর্যন্ত শুধু হলিউড এ দেখেছি বা যেটা শুধু মাত্র এক সায়েন্স ফিকশন ছিল সেই প্রকারের কোন প্রযুক্তি সত্যিসত্যি চলে আসতে পারে ভবিষ্যতে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কি প্রযুক্তি আসবে তা দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হতে পারে ৫-৬ বছর।
শেষ কথা
আশা করি আজকের এই পোস্ট টি খুব উপভোগ করেছেন। আমি আমার পোস্ট গুলোতে প্রজুক্তিকে খুব একটা বেশি টেকনিক্যাল বিষয়ে নিয়ে যাই না। সহজ ভাষায় এবং বাস্তব উদাহরনের মাধ্যমে প্রযুক্তিকে বোঝানোর চেষ্টা করে থাকি যাতে সকল প্রকার পাঠক সহজেই পুরো বিষয়টা বুঝতে পারে। যাই হোক আজকের পোস্ট টি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। জানেনই তো শেয়ার করা মানেই কেয়ার করা।