দিনে কত ঘন্টা মোবাইল চালানো উচিত – (সঠিক সময় সীমা)
আমরা কেন বারবার মোবাইল ব্যবহার করতে চাই ?
দিনে কত ঘন্টা মোবাইল চালানো উচিত: আমরা প্রায়ই শিশুদের শাসন করে থাকি, তাদের বেশি মোবাইল ব্যবহারের প্রবণতা নিয়ে। কিন্তু, তাই বলে, কি আমাদের মতো বড়দের ক্ষেত্রেও কি রয়েছে মোবাইল ব্যবহারের সময়ের সীমাবদ্ধতা ?
আজ্ঞে, হ্যাঁ আমাদেরও অত্যাধিক মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত।
কারণ, কাজের প্রয়োজনে আমরা যেমন ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটার বা ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে কাটাই, তেমনই আমাদের অবসরের বেশিরভাগ সময়ই কাটে ফোনে সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে, টিভির সামনে কিংবা ট্যাবলেটে গল্প পড়ে।
আর, বিশেষ করে করোনা মহামারীর জেরে আমাদের প্রায় সবারই সময় প্রায় অনলাইনেই, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কেটে গেছে।
কারণ, সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং-এর কারণে অনেকেই অনলাইন কথোপকথনের উপর নির্ভর করেছিল।
তবে, এখন প্রশ্ন হল এই যে, তবে কি এই অত্যধিক মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে আটকে থাকার ফলে, এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব কি আমাদের উপর পড়ছে ?
তাহলে, চলুন আমাদের এই আর্টিকেলে আলোচনা করা যাক যে, বেশিক্ষণ স্ক্রিনের সামনে থাকাটা ঠিক কতটা অস্বাস্থ্যকর; আর আমাদের দিনে ঠিক কত ঘন্টা মোবাইল চালানো উচিত ? – এই সমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে।
প্রথমে আমরা জানি,
আমরা কেন বারবার মোবাইল ব্যবহার করতে চাই ?
আমাদের মস্তিষ্কে বেশ কয়েকটি কক্ষ আছে; যা থেকে ডোপামিন নামের এক ধরণের রাসায়নিক ক্ষরিত হয়;
যখন আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি অনুকূল থাকে, তখন এই রাসায়নিকটি আমাদের মনকে ভালো অনুভব করতে সাহায্য করে।
আর, গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক মানুষের কাছেই মোবাইলের মাধ্যমে সামাজিক মিডিয়ায় লোকজনের সাথে ইন্টারেক্ট করলে, তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের ক্ষরণ হয়।
আর, বর্তমানে সময়ে, বহু মানুষই তাদের অবসরের বেশিটা সময় মোবাইলের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য কোনো অ্যাপ ব্যবহার করে কাটায়।
এবং, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মস্তিষ্কের বারংবার ডোপামিন ক্ষরণ তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ ধরে মোবাইল ব্যবহার করতে আকৃষ্ট করে তোলে।
আর, ধীরে-ধীরে এই নিয়মিত ডোপামিনের ক্ষরণ মোবাইল ব্যবহারের প্রতি মানুষকে আসক্ত করে তোলে।
আর, আমরা জানি যে, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার করতে থাকলে, আমাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে চরম মোবাইল আসক্তি।
এর থেকে জন্ম নিতে পারে নানান রকমের সমস্যাও।
একটানা মোবাইল বা স্ক্রিনের সামনে সময় কাটালে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে –
অনেক চিকিৎসকরা মানুষের অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের বিষয় নিয়ে বেশ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তাঁদের মতে, একটানা মোবাইল ব্যবহার করলে বা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকলে মানুষের নানান ধরণের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে; যথা-
১. হরমোনাল ইমব্যালেন্স থেকে হতাশা ও উদ্বেগ
২. মানুষের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া
৩. কুঁজো হয়ে যাওয়া, শোওয়া-বসার ভঙ্গি পাল্টে যাওয়ায় ক্রনিক ব্যথার সমস্যা
৪. অনিদ্রা ও মাথাব্যথা
৫. নিজের আত্মসম্মান নিয়ে উদ্বেগ
৬. চোখের সমস্যা
৭. কোমর, পিঠ কিংবা ঘাড়ের সমস্যা
৮. শরীরের ফিটনেস বা সচলতা হারিয়ে ফেলা
৯. মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়া
১০. শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া
এর মধ্যে বেশ কিছু লক্ষণ হয়তো, আপনার কিংবা আপনার আশেপাশে থাকা মানুষজনেরও হয়ে থাকতে পারে।
যেটা কখনোই একজন মানুষের সুস্থ জীবনযাত্রার অংশ হতেই পারে না।
এখন প্রশ্ন হল, সুস্থ থাকতে গেলে, তাহলে আমাদের সারাদিনে কতক্ষণ মোবাইল চালানো উচিত ?
দিনে কত ঘন্টা মোবাইল চালানো উচিত ?
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা নানান ধরণের অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছেন যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক বা প্রাপ্তমনস্ক ব্যক্তির উচিত – তার রোজদিনের কাজের বাইরে প্রতিদিন দুই ঘণ্টার কম মোবাইল বা যেকোনো ধরণের ডিভাইস ব্যবহার করা।
তাঁদের মতে, যে টাইমটা আপনি অহেতুক স্ক্রিনের সামনে থেকে বরবাদ করছেন; তার জায়গাতে আপনি যদি অন্য কোনো শারীরিক কার্যকলাপে নিযুক্ত থাকেন, তাহলে সেটা আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে অনেকটাই ফলপ্রদ হবে।
তবে, একবার দীর্ঘক্ষণ ধরে ফোন ঘাঁটার অভ্যাস তৈরী হয়ে গেলে, তা সহজে যাওয়া মুশকিল।
কিন্তু, আপনি ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে থাকলে, নিশ্চয়ই আপনার সারাদিনের ফোনের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবেন।
গুগল ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং ও অ্যাপল স্ক্রিনটাইম:
মানুষের নিয়মবিহীন ফোন ঘাঁটার অভ্যাসকে কমিয়ে আনার জন্যে অ্যাপল ও গুগল তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোতে যথাক্রমে- ইনবিল্ট স্ক্রিনটাইম ও গুগল ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং নামের এক ধরণের অ্যাপ্লিকেশন যুক্ত করেছে।
যা আপনাকে ঘন্টা, দিন ও সপ্তাহের মধ্যে আপনি কতটা সময় ফোনে কাটিয়েছেন, তার হিসাব রাখে।
আর, আপনি যদি দেখেন যে, আপনি একটি নির্দিষ্ট অ্যাপে খুব বেশি সময় কাটাচ্ছেন, তবে এই অ্যাপগুলো আপনার সেই অ্যাপটি ব্যবহারের সময়সীমা বেঁধে দেয়।
এই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে, আপনি সেদিনকার মতো আপনার মোবাইলে, ওই অ্যাপটি ব্যবহার না করার নোটিফিকেশন পাবেন কিংবা অ্যাপটিকে ওইদিন দিন আর আপনি ব্যবহার করতে পারবেন না।
প্রাক-কিশোর, কিশোর-কিশোরী ও প্রাপ্ত বয়স্কদের মোবাইল ব্যবহারের সময়সীমা:
আপনি যদি দিনে আট ঘন্টা ফোন ব্যবহার করেও, সুখী, উৎপাদনশীল ও ভালো বোধ করেন; তবে, আপনি নিশ্চিন্তে মোবাইলে সময় কাটাতে পারেন।
অন্যদিকে, যাদের বেশিক্ষণ মোবাইলের সামনে থাকলে স্ট্রেসড, হতাশ, উদ্বিগ্ন কিংবা বিভ্রান্তিকর লাগে; তাদের অবশ্যই উচিত ফোন ঘাঁটার সময়কে সারাদিনে ২ ঘন্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া।
এই দুই ক্ষেত্রে, আপনার যেটা ঠিক মনে হয়, সেটাই করা উচিত; কারণ জোর করে বা হঠাৎ করে ফোনের ব্যবহার কমিয়ে ফেলা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়।
এতে, যথেষ্ট সময়ও লাগতে পারে।
শিশুদের মোবাইল ব্যবহারের সময়সীমা:
বর্তমান সময়ে শিশুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে মোবাইল ব্যবহারের প্রচলন দেখা যায়,
বিশেষ করে করোনা মহামারী চলাকালীন অনলাইন ক্লাসের জন্যে এই ব্যবহার চরমে ওঠে।
তাই, ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স গাইডলাইনস অনুসারে, শিশুদের স্বাভাবিক সুস্থতার জন্যে তাদের মোবাইল ব্যবহারের উপর বেশ কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠান বলেছে যে, ২ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদেরকে কোনও ধরণের স্ক্রিনের সংস্পর্শে আনা একেবারেই অনুচিত।
২ থেকে ৪.৯ বছর বয়সী বাচ্চারা, প্রতিদিন সর্বমোট এক ঘন্টা করে অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে মোবাইল ব্যবহার করতে পারে।
আর, ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যবহার সারাদিনে দুই ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে থাকা উচিত।
পরিশেষে:
সবসময় খেয়াল রাখবেন যে, আপনার মোবাইল ব্যবহারের সময়টা যাতে আপনার অন্যান্য ক্রিয়াকলাপগুলোর সামনে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিটি শিশু, কিশোর-কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের উচিত – সুস্থ থাকার জন্যে যথাযথভাবে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, ঘুম, পরিবার ও সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও এর পাশাপাশি নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন ও নিজেদের দক্ষতার বিকাশ ঘটানো।
যাতে, তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত হয় ও দেশের বিকাশের জন্য তা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়।
কারণ, স্বাস্থ্যই হল আমাদের মূল সম্পদ।
আমাদের আজকের মোবাইল ব্যবহারের সময়সীমা নিয়ে লেখা আর্টিকেল এখানেই শেষ হল।
আশা রাখি, আপনারা নিজের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই যথাযথভাবে মোবাইলের ব্যবহার করবেন!