ব্রডব্যান্ড ওভার পাওয়ার লাইন | বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন থেকেই ব্রডব্যান্ড?
বিপিএল কি স্মার্ট ভবিষ্যৎ আনয়ন করবে?
বর্তমান প্রজন্মের একটিই চাহিদা—যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে দ্রুতগামী ইন্টারনেট সংযোগ। কিন্তু আপনি যদি কোন গ্রামীণ এলাকাতে বসবাস করেন, তবে যেকোনো টেলিকম কোম্পানির কাছেই আপনার পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড পৌঁছানোটা অনেক ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। তবে চিন্তার কোন কারন নেই—কেনোনা এই সমস্যার সমাধান করতে আমরা বিপিএল (ব্রডব্যান্ড ওভার পাওয়ার লাইন) ব্যবহার করতে পারি। বিপিএলকে অনেক সময় ইওপি (ইথারনেট ওভার পাওয়ার) বলা হয়ে থাকে। বিপিএল প্রযুক্তিতে বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বয়ে আনা সম্ভব। তো বন্ধুরা চলুন আজকের বিষয়টির সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু সমূহ
এক লাইনেই দুই সিগন্যাল
আপনি যদি ইতিমধ্যে আমার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি পড়ে থাকেন, তবে আপনি অবশ্যই জানেন যে—একটি সাধারন টেলিফোন লাইনে একাধিক আলাদা চ্যানেল থাকে। এদের মধ্যে কোন চ্যানেল ফোন কল বহন করে, আবার কোনটা ডাউনলোড (ইন্টারনেট থেকে যে তথ্য গুলো আপনার বাড়িতে আসে) নিয়ন্ত্রন করে এবং কোন চ্যানেল আপলোড (আপনি যে তথ্য গুলো ইন্টারনেটের কাছে পৌছিয়ে দেন) নিয়ন্ত্রন করে। ব্রডব্যান্ড লাইনে নিম্ন ফ্রিকুয়েন্সির ইলেকট্রিকাল সিগন্যাল ব্যবহার করে সাধারন ফোন কল গুলো নিয়ন্ত্রন করা হয় এবং উচ্চ ফ্রিকুয়েন্সির ইলেকট্রিকাল সিগন্যাল ব্যবহার করে ইন্টারনেট সরবরাহ করানো হয়।
কথাটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগলো তাই না? কারন, একই তারের মধ্যে একই সময়ে দুই ধরনের ইলেকট্রিকাল সিগন্যাল পাঠানো কি সত্যিই সম্ভব? হ্যাঁ, এটি সম্ভব, একই জিনিসের মধ্যদিয়ে একাধিক সিগন্যাল পাঠানো একদম সহজ ব্যাপার। আমরা মানুষেরা প্রায় সবসময়ই এমনটা করে থাকি। মনে করুন আপনি একটি কোলাহল পূর্ণ কোন রেস্টুরেন্টে বসে আছেন, যেখানে একই স্থানে একই সময়ে বিভিন্ন টেবিলে বসে থাকা বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করছে। কিন্তু আপনি চাইলেই যেকোনো একটি আলাপ আলোচনার দিকে সহজেই আপনার ধ্যান লাগাতে পারবেন। রেস্টুরেন্টের ঘরটি একটি বিশাল নলের মতো কাজ করে, যা একসাথে অনেক ধরনের শব্দ আপনার কান পর্যন্ত বহন করে আনছে। কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক সিলেক্টিভ অ্যাটেনশন পদ্ধতি ব্যবহার করে আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে যেকোনো আলাপ আলোচনা থেকে আরেকটি আলাপ আলোচনার দিকে আপনার কানকে নিয়ে যেতে পারে। এর ফলে আপনি সেই সময় শুধু নির্দিষ্ট কোন আলাপ আলোচনায় শুনতে পান।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট অনেকটা একই সিস্টেমের উপরে কাজ করে। একটি সিঙ্গেল টেলিফোন তারের টুকরা একইসাথে টেলিফোন কল এবং ইন্টারনেট দুইটাই বহন করে; আপনার টেলিফোন সেখান থেকে শুধু কল গুলোকে শুনতে পায় এবং আপনার রাউটার শুধু ইন্টারনেটকে শোনে।
বিপিএল
আপনি যদি ফোনের লাইনের মধ্যদিয়ে কম্পিউটার ডাটা আদান প্রদান করাতে পারেন, তবে কেন বৈদ্যুতিক লাইন দিয়ে এই ডাটা আদান প্রদান করাতে পারবেন না? উন্নত দেশ গুলোতে কিছু ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডাররা ইতিমধ্যেই বৈদ্যুতিক লাইন দিয়ে ইন্টারনেট প্রবাহ করিয়ে গ্রামীণ এলাকাতে পৌছিয়ে দিয়েছে। বিপিএল একদম টেলিফোন ব্রডব্যান্ডের মতোই কাজ করে; এতে একসাথে দুই প্রকারের সিগন্যাল থাকে, একটি উচ্চ ফ্রিকুয়েন্সির ইলেকট্রিকাল সিগন্যাল থাকে যা ব্রডব্যান্ড ডাটা সেন্ড করে এবং আরেকটি নিম্ন ফ্রিকুয়েন্সির ইলেকট্রিকাল সিগন্যাল থাকে যা সাধারন বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহ করে থাকে।
এখন এই বিপিএল লাইন থেকে ইন্টারনেটকে আলাদা করার জন্য আপনার প্রয়োজন পড়বে একধরণের বিশেষ বিপিএল মোডেম। মোডেমটি আপনার কম্পিউটারের সাথে লাগানো মাত্রই ইন্টারনেট চলা শুরু হয়ে যাবে।
বিপিএল কি স্মার্ট ভবিষ্যৎ আনয়ন করবে?
বিপিএল সত্যিই এক নতুন ভবিষ্যৎ সম্ভবনার দরজাকে খুলে দিয়েছে। একবার চিন্তা করে দেখুন, যদি আমরা সাধারন বৈদ্যুতিক লাইন ব্যবহার করে আমাদের কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযুক্ত করতে পারি তাহলে প্রত্যেকটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করানো থেকে আমাদের আর কেউই আটকাতে পারবে না। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা সহজেই তৈরি করতে পারবো স্মার্ট হোম (যেখানে প্রত্যেকটি যন্ত্রপাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইলেক্ট্রনিক নিয়ন্ত্রক বা কম্পিউটারের মাধ্যমে অন বা অফ হবে)। আর হয়তো এটি কয়েক বছরের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যাবে।
কিন্তু চলুন বিস্তর এক ভবিষ্যতের কল্পনা করা যাক, যেখানে হয়তো আপনার অফিসের কম্পিউটার ওয়েব ব্রাউজার থেকে আপনার বাড়ির রান্না ঘরে থাকা রাইস কুকার নিয়ন্ত্রন করতে পারছেন। অথবা আপনার মোবাইল ওয়েব ব্রাউজার থেকে আপনার ঘরের লাইট, ফ্যান, টিভি ইত্যাদি অন বা অফ করতে পারবেন যখন আপনি দূরে কোন হোটেলে থাকবেন। এভাবে এই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ সম্ভবনার কথা ভেবে দেখুন, বিপিএল আপনাকে দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণ করার এক পরবর্তী লেভেল খুলে দেবে।
বিপিএলের সুবিধা এবং অসুবিধা
সুবিধা সমূহ—
- প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই বৈদ্যুতিক লাইন সর্বব্যাপী রয়েছে।
- ব্যয়বহুল টেলিফোন লাইন ব্রডব্যান্ডের তুলনায় বিপিএল অনেক দ্রুত, সহজ, এবং সস্তা প্রযুক্তি যা সহজেই বহুদূরের পল্লী এলাকাতে পৌঁছানো সম্ভব।
- ব্রডব্যান্ড ওভার পাওয়ার লাইন একটি সহজ এবং সাধারন প্রযুক্তি।
- বৈদ্যুতিক লাইনের কোম্পানি, যারা ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে তারা একই লাইন ব্যবহার করে বর্তমান গ্রাহকদের সস্তায় ব্রডব্যান্ড সরবরাহ করতে পারবে। এতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম অনেক কমে যাবে।
- বাড়িতে বিপিএল প্রযুক্তি ওয়াইফাই এর সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং এটি আরো রেঞ্জ প্রদান করতে সাহায্য করবে।
অসুবিধা সমূহ—
- ব্রডব্যান্ড ওভার পাওয়ার লাইন এখনো পর্যন্ত এক বিরল প্রযুক্তি। উন্নত দেশ গুলোতে এর প্রচলন শুরু করা হলেও এটি এখনো পর্যন্ত তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।
- শুধু মাত্র নিম্ন এবং মধ্যম ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারকে ব্রডব্যান্ড ওভার পাওয়ার লাইনের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব।
- বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভোল্টেজের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে, ফলে বিপিএলের যন্ত্রপাতি আন্তর্জাতিকভাবে বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়বে।
- বেশি দূরত্বে সিগন্যাল পাঠানোর জন্য সিগন্যাল বুস্টার ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে। ট্রান্সফরমার, সার্কিট ব্রেকার, ব্রডব্যান্ড সিগন্যালকে বাঁধা প্রদান করতে পারে।
- বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই ডিএসএল বা ওয়্যারলেস সিস্টেমের রাউটার ব্যবহার করে থাকে, তারা বিপিএল এর জন্য নতুন কোন মোডেম বা রাউটার কিনতে তেমন আগ্রহী হবে না।
আমার কথা
হয়তো বা বর্তমান টেলিফোন লাইন বা মোবাইল ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীগনের কাছে বিপিএল তেমন জনপ্রিয়তা পাবে না, কিন্তু বহুদুরে গ্রামে থাকা মানুষের জন্য এই প্রযুক্তি নিশ্চিত বয়ে আনবে এক ডিজিটাল ভবিষ্যৎ। এর সম্ভবনার কোন শেষ নেই, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো কি কি করা যেতে পারে তা নিয়ে নিচে আলোচনা করতে পারেন। পোস্টটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করুন, আপনার যেকোনো মতামতে আমাকে কমেন্ট করে জানান। ধন্যবাদ