ব্লকচেইন টেকনোলজি : এটি কি এবং কিভাবে কাজ করে?
এই বিষয়টি অনেক পুরনো হলেও গত বছর বিটকয়েন নিয়ে মানুষের আগ্রহ এবং ক্রিপটোকারেন্সির জনপ্রিয়তা বাড়ার পরেই এই ব্লকচেইন টেকনোলজি নিয়ে মানুষের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কারণ, বিটকয়েন বা অন্যান্য অধিকাংশ ক্রিপটোকারেন্সি এই ব্লকচেইন টেকনোলজির ওপরেই ভিত্তি করে কাজ করে। তাই ক্রিপটোকারেন্সি কি এবং কিভাবে কাজ করে সেটা জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে জানতে হবে এর পেছনের প্রযুক্তিটি নিয়ে। তাই আজকে আলোচনা করবো এই ক্রিপটোকারেন্সির পেছনের প্রযুক্তি, ব্লকচেইন কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে। এই সম্পূর্ণ ব্লকচেইন টেকনোলজিটিই মূলত একটু সহজ ভাষায় এবং অল্প কথায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। চলুন, প্রথমেই জানা যাক,
ব্লকচেইন কি?
প্রথমেই এই টার্মটির দিকে একটু ভালো করে খেয়াল করুণ। তাহলেই একটি বেসিক ধারণা পাবেন যে এই নামটি দিয়ে আসলে কি বোঝানো হচ্ছে। ব্লকচেইন মানে বলা হচ্ছে ব্লক দিয়ে তৈরি চেইন বা ব্লকের চেইন। চেইন কি তা আমরা সবাই জানি। অনেকগুলো একই ম্যাটেরিয়াল পাশাপাশি একটির সাথে আরেকটি যোগ করার মাধ্যমে সেগুলোকে একটি শিকলের মত করাকেই চেইন বলা হয়। তাহলে ভেবে দেখুন, অনেকগুলো ব্লককে একটির সাথে আরেকটি জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে ব্লকের একটি শিকল তৈরি করাকেই বোঝানো হচ্ছে ব্লকচেইন টার্মটির দ্বারা। আচ্ছা, আর যে ব্লকগুলোর দ্বারা এই চেইনটি তৈরি করা হয় সেই ব্লকগুলো মূলত ইনফরমেশন স্টোর করে। ব্লকচেইন টেকনোলজিটি অনেক আগে থেকেই আছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাবহারও হয়ে আসছে। কিন্তু সাধারন মানুষের এই টেকনোলজিটির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় মূলত ২০০৯ সালে বিটকয়েন নামের ক্রিপটোকারেন্সিটি উদ্ভাবন হওয়ার পরে। টেকনিক্যালি বলতে হলে ব্লকচেইন হচ্ছে একটি ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার, যেটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। ব্লকচেইনের ব্লকগুলোর মধ্যে যখন একটি ডেটা ইন্টার করা হয়, তখন ওই ডেটাটিকে ডিলিট করা বা ডেটাটির কোন ধরনের পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কিভাবে?
অলরাইট, এটা জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে যে এই ব্লকগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি ব্লকে কি থাকে। সম্পূর্ণ ব্লকচেইনের প্রত্যেকটি সিঙ্গেল ব্লকে মূলত তিনটি জিনিস থাকে- ডেটা, হ্যাশ এবং চেইনে তার আগের ব্লকটির হ্যাশ। অর্থাৎ, ব্লকচেইনের থাকা প্রত্যেকটি ব্লকে থাকে সেই ব্লকটির নিজস্ব ডেটা, ব্লকটির নিজের হ্যাশ এবং ঠিক তার পেছনে যুক্ত থাকা আগের ব্লকটির হ্যাশ। ডেটা বুঝলাম, কিন্তু হ্যাশ জিনিসটি কি? হ্যাশ হচ্ছে মূলত একটি আইডেন্টিফায়ার। প্রত্যেকটি ব্লকের হ্যাশ তার একেবারেই নিজস্ব এবং প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট। অর্থাৎ, দুটি ব্লকের হ্যাশ কখনোই একই হতে পারবে না। এই বিষয়টি অনেকটা মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মত। দুটি মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট যেমন একই হতে পারবে না কখনোই, তেমনি দুটি ব্লকের হ্যাশও কখনো মিলবে না। আর এই হ্যাশগুলো জেনারেট হয় প্রত্যেকটি ব্লকের স্টোর করা ডেটা অনুযায়ী। যার মানে, একটি ব্লকের ডেটা যদি কোনরকম পরিবর্তন করা হয়, তাহলে ওই ব্লকটির হ্যাশও চেঞ্জ হয়ে যাবে। এবার চিন্তা করে দেখুন, প্রত্যেকটি ব্লক কেন তার আগের ব্লকের হ্যাশও থাকে। প্রত্যেকটি ব্লক যদি তার আগে যুক্ত থাকা হ্যাশটিও রাখে, তাহলে কোন ব্লকের ডেটা কেউ ইচ্ছামত চেঞ্জ করে ফেলতে পারবে না। তাই ব্লকচেইনে ইন্টার করা প্রত্যেকটি ডেটা ডিলিট করা বা চেঞ্জ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, এক্ষেত্রে আপনি যদি একটি ব্লকে থাকা ডেটা চেঞ্জ করতে চান, তাহলে আপনাকে ওই ব্লকটির সাথে তার আগের সবগুলো ব্লকের ডেটা চেঞ্জ করতে হবে, নয়ত সম্পূর্ণ ব্লকচেইনটি ইনভ্যালিড হয়ে যাবে বা কাজ করবে না আর।
ব্লকচেইন কিভাবে কাজ করে?
এতক্ষনে নিশ্চই বুঝে গিয়েছেন যে ব্লকচেইন টেকনোলজি কিভাবে সিকিউরিটি নিশ্চিত করে। কিন্তু ব্লকচেইন সিকিওর হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, এটির নেটওয়ার্ক ডিসট্রিবিউটেড। ব্লকচেইন মূলত একটি P2P নেটওয়ার্ক তৈরি করে যেখানে ব্লকচেইনের প্রত্যেকটি ব্লকের ডেটা ইন্টারনেটে কানেক্টেড থাকা যেকোনো ব্যাক্তি ব্লকগুলোকে ভেরিফাই করতে পারে। যখন কোন নতুন একজন এই ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে রেজিস্টার করে, তখন সে তার সামনের এনবং তার আগের সব ব্লকগুলোর কপি পেয়ে যায় এবং সে প্রত্যেকটি ব্লককে ভেরিফাই করে এবং নিশ্চিত করে যে ব্লকচেইনে থাকা প্রত্যেকটি ডেটা এখনও ঠিক আছে। ব্লকচেইনের প্রত্যেকটি ব্লক যত বেশি বার ভেরিফাই করা হয়, ডেটাগুলো ততই বেশি অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠে। মুলত এভাবেই ব্লকচেইন টেকনোলজি এগিয়ে যেতে থাকে। আমরা সবাই জানি যে বিটকয়েন ট্র্যানজেকশনগুলো ব্লকচেইন টেকনোলজির ওপরে ভিত্তি করে কাজ করে। চলুন দেখা যাক, এটি কিভাবে কাজ করে?
ধরুন, আপনার কাছে ৫ বিটকয়েন আছে এবং আপনি সেখান থেকে ২ বিটকয়েন আমাকে সেন্ড করতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে এই অ্যামাউন্টটি আপনার ওয়ালেট থেকে আমার ওয়ালেটে ট্রান্সফার হবে। যখন আপনি আমার ওয়ালেট অ্যাড্রেসে বিটকয়েনটি পাঠিয়ে দেবেন, ঠিক তখন এই লেন-দেনটির সব ডিটেইলস নিয়ে ব্লকচেইনে একটি নতুন ব্লক তৈরি হবে। এই ব্লকটির ডেটা হিসেবে থাকবে সেন্ডার অর্থাৎ আপনার ওয়ালেট অ্যাড্রেস, রিসিভার অর্থাৎ আমার ওয়ালেট অ্যাড্রেস এবং আপনি যতটুকু বিটকয়েন সেন্ড করবেন তার অ্যামাউন্ট। এবার এই নতুন ব্লকটি ব্লকচেইনে কানেক্টেড থাকা সবার সামনে আসবে ভেরিফাই করার জন্য। তারা সবাই যখন এই ব্লকটিকে ভেরিফাই করবেন বা নিশ্চিত করবেন যে সব ঠিক আছে, তখন এই ট্র্যানজেকশন রেকর্ডটি ব্লকচেইনে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে এবং ট্র্যানজেকশনটি কমপ্লিট হবে। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে এই ব্লক ভেরিফাই করার কাজটি যারা করে থাকে তাদেরকেই বলা হয় বিটকয়েন মাইনার। আর, এই ট্র্যানজেকশনটি প্রোসেস করার জন্য আপনাকে যতটুকু ফি হিসেবে দিতে হবে, তার অধিকাংশই পাবে বিটকয়েন মাইনাররা, যারা তাদের হার্ডওয়্যার ব্যাবহার করে বিটকয়েন মাইনিং করেছেন বা এই ব্লক ভেরিফাই করার কাজটি করেছেন। এবার নিশ্চই কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পেয়ছেন যে ব্লকচেইন কিভাবে কাজ করে এবং বিটকয়েন মাইনিং করলে কেনই বা মাইনাররা বিটকয়েন আয় করতে পারেন।
ক্রিপটোকারেন্সি ফ্যাক্ট : আপনি কি জানেন প্রত্যেকটি বিটকয়েন ট্র্যানজেকশন প্রোসেস হতে সাধারণত মিনিমাম ১০ মিনিট সময় কেন লাগে? এর কারণও এই ব্লকচেইন। বিটকয়েন ট্র্যানজেকশনের ক্ষেত্রে সিকিউরিটির চিন্তা করে প্রত্যেকটি নতুন ব্লক প্রতি ১০ মিনিট পরপর তৈরি করা হয়। তাই আপনি একটি ট্র্যানজেকশন রিকুয়েস্ট করলে ওই ট্র্যানজেকশন নিয়ে নতুন একটি ব্লক তৈরি করতে ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।
আশা করি, সহজভাবে অল্প কথায় বোঝাতে পেরেছি যে ব্লকচেইন কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে। আজকের মত এখানেই শেষ করছি। আশা করি আজকের লেখাটি আপনাদের ভালো লেগেছে। কোন ধরনের প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট সেকশনে জানাবেন।