ইন্টারনেট প্রোটোকল ক্যামেরা বা আইপি ক্যামেরা বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী সার্ভিলেন্স তথা নজরদারি,মনিটরিং এর কাজে ব্যবহৃত অনেক বেশি ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় ক্যামেরা। ১৯৯৬ সালে এক্সিস নেটওয়ে নামক একটি প্রতিষ্ঠান বানিজ্যিকভাবে আইপি ক্যামেরা প্রযুক্তি উন্মুক্ত করে। বর্তমানে সিকিউরিটি,সার্ভিলেন্স,মনিটরিং এর কাজে মানুষের এর এই আইপি ক্যামেরার প্রতি ঝোক বেশি।
কেন আইপি ক্যামেরা?
আইপি ক্যামেরা বা ইন্টারনেট প্রটোকল ক্যামেরা এর নাম থেকেই কাজের ধরন আন্দাজ করা যায়। এখানে আইপি ক্যামেরা ছবি, ফুটেজ,অডিও এসব এসব ট্রান্সফারিং করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট এর মাধ্যমে।এখানে একাধিক আইপি ক্যামেরার জন্য একটি নেটওয়ার্ক ভিডিও রেকর্ডার বা NVR এর এসব ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত ডাটা রেকর্ড করে। NVR হল একটি ডিজিটাল এম্বেডেড সফটওয়্যার যেটি IP ক্যামেরা গুলো থেকে প্রাপ্ত ডাটা, যেমনঃ ছবি,ভিডিও ; এগুলো মেমোরি কার্ড, ফ্লাস ড্রাইভে স্ট্যান্ডার্ড ইমেজ ও ভিডিও ফরম্যাট আকারে সেইভ করে। IP বা ইন্টারনেট প্রোটোকল সার্ভিলেন্স সিস্টেমে NVR কাজ করে। আইপি ক্যামেরাগুলো রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ এর মাধ্যমে এসব NVR এর সাথে যুক্ত হয়।এখানে রাউটার ব্যবহার করা হলে তারের ব্যবহার নেই বললেই চলে।
আবার যদি বহু আগে থেকে প্রচলিত CCTV ক্যমেরার দিকে তাকাই, তবে দেখা যায় যে এগুলো coax নির্ভর ক্যামেরা। এইসব ক্যামেরা প্রত্যেকটি coax ক্যাবলের মাধ্যমে একটি DVR বা ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার এর সাথে যুক্ত থাকে। এইসব DVR বক্সে ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত ফুটেজ ভিডিও আকারে সেইভ করার জন্য কিছু হার্ডওয়্যার থাকে, এর ফলে বক্সে থাকা একটি হার্ডড্রাইভে ভিডিও গুলি সেইভ হয়। প্রচলিত CCTV প্রযুক্তিতে ক্যামেরার ভিডিও ধারন করার জন্য এই আলাদা হার্ডওয়্যার বা DVR ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে,আইপি ক্যামেরাগুলোর প্রত্যেকটিতে নিজস্ব ইনবিল্ট রেকর্ডিং ফিচার থাকে, অর্থাত এখানে ক্যামেরা থেকে ডাটা একপ্রকার ডিজিটাল মিডিয়া ফরম্যাটেই যায়, NVR কেবল তা সব ডিভাইসের জন্য বোধগম্য করে। আইপি ক্যামেরার ভেতর থাকা ট্রান্সমিটার এর কারনে তার ছাড়াই একে যেকোন জায়গায় ফুটেজ ক্যাপচারিং এর জন্য সেট করা যায়। এতে করে ক্যামেরাটিকে একটি ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করে দিলেই, যেকোন জায়গা থেকে ক্যামেরাটির জন্য তৈরি বিশেষায়িত সফটওয়্যার বা আমরা তাকে NVR বলতে পারি তার মাধ্যমে উক্ত ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যাবে।
তবে, প্রচলিত ক্যাবল দিয়ে সংযুক্ত ক্যামেরার ভিডিও এভাবে যেকোন জায়গা থেকে ওয়্যারলেস ভাবে নিয়ন্ত্রন ও দেখা সম্ভব না। এক্ষেত্রে আমাদের DVR এর হার্ডডিস্ক ও এর সাথে লাগানো মনিটর এর ওপর নির্ভর করতে হয়। সুতরাং দূরে এবং যেকোন জায়গা থেকে নজরদারি ও ক্যামেরা নিয়ন্ত্রন এর ক্ষেত্রে আইপি ক্যামেরা এগিয়ে।
নিঃসন্দেহে আইপি ক্যামেরা ও সাধারন ক্যাবলে সংযুক্ত ক্যামেরার আকার আকৃতি একইরকম হলেও, আইপি ক্যামেরার ভিতরকার কমপোনেন্ট অনেক বেশি এবং হার্ডওয়্যার অনেক উন্নত। আর এই কারনে সার্ভিলেন্স এর কাজে ব্যবহৃত অন্যসব ক্যামেরা প্রযুক্তির চাইতে আইপি ক্যামেরা প্রযুক্তির দাম বেশি পড়ে।
শাওমি আইপি ক্যামেরাঃ
আশা করি আইপি ক্যামেরা কি এবং উপকারিতা, কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারনা পেয়েছেন। তাই আপনাদের মাঝে রিভিউ করব একটি আইপি ক্যামেরা। এটির নাম হল শাওমি পোর্টেবল আইপি ক্যামেরা। ধন্যবাদ জানাই সোর্স অফ প্রোডাক্ট কে এই ক্যামেরা এর জন্য। এটি সাইজে ছোট খাট এবং খুবই কার্যকরি একটি স্মার্ট আইপি ক্যামেরা। এর দৈর্ঘ্য ৫.৭ সেন্টিমিটার এবং প্রস্হ ৪.৮ সেন্টিমিটার, সুতরাং বুঝতে পাচ্ছেন খুবই কমপ্যাক্ট একটি মিনি ডিভাইস। এই আপনি ক্যামেরাটি সম্পূর্ণ প্লাস্টিক বিল্ড এবং মান তুলনামূলক ভালো। এর নিচে একটি ফোল্ডিং স্ট্যান্ড রয়েছে,এটি একটি ম্যাগনেটিক স্ট্যান্ড আর সে কারনে যেকোনরকম মেটালিক সারফেসে এটি সহজে আটকে যায়। ক্যামেরাটি ৩৬০ ডিগ্রী ঘোরানো যায়।
পছন্দনীয় একটি সারফেসে মাউন্ট করে একে সুবিধামত দিকে ঘুরিয়ে রাখা যাবে।ক্যামেরার নিচের মাউন্টটি আনফোল্ড করলে নিচে একটি সেটাপ বাটন ও এসডিকার্ড স্লট দেখা যাবে। ডাটা ক্যামেরাটিতেই সেইভ করে রাখার ক্ষেত্রে এসডি কার্ড লাগিয়ে রাখা যাবে। আবার ঠিক পিছে ২.০ মাইক্রো ইউএসবি পোর্ট পাওয়ার এর জন্য এবং তারওপর ২.০ ইউএসবি পোর্ট রয়েছে পেনড্রাইভ বা ফ্লাস ড্রাইভ ব্যবহারের জন্য। কেউ যদি মেমোরি কার্ড ব্যবহার না করতে চান, তবে মাইক্রো ইউএসবি পাওয়ার পোর্ট এর ওপরের ইউএসবি পোর্টে পেনড্রাইভ ব্যবহার করতে পারেন। তবে আপনি ইচ্ছা করে দুটির কোন টাই ব্যবহার নাও করতে পারেন। এর বিকল্প কি সেটা নিচে জানবেন।
ক্যামেরা টিকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে শাওমির তৈরি MiHome অ্যাপলিকেশন দিয়ে। এই অ্যাপলিকেশনটি ওপেন করে আগে রিজিওন সিলেক্ট করতে হবে চায়না, তারপর শাওমি একাউন্ট দিয়ে লগইন করে Add Device অপশনে যেতে হবে। আর ঠিক এইসময় ক্যামেরার নিচে থাকা সেটাপ বাটনটিকেও প্রেস করতে হবে, আর এতে করে অ্যাপটি এই ক্যামেরাকে ডিটেক্ট করে ফেলবে , এভাবে ছোট একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনার ফোনের MiHome অ্যাপলিকেশন এবং এই পোর্টেবল আইপি ক্যামেরাটি পেয়ার হয়ে যাবে। এই সহজ সেটাপের পর থেকে আইপি ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত ইমেজ, ফুটেজ রেকর্ড এবং নিয়ন্ত্রন করা যাবে স্মার্টফোনের এই MiHome অ্যাপলিকেশন দিয়েই, অর্থাত এখানে NVR বলা যেতে পারে MiHome অ্যাপলিকেশনটিকে। আইওএস এবং এন্ড্রয়েড চালিত যেকোন ডিভাইস দিয়ে এই শাওমি আইপি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রন করা যাবে।এখান থেকে ছবি ক্যাপচার ও ভিডিও রেকর্ডিং করা যাবে যাবে আর এক্ষেত্রে এগুলো ফোন মেমোরিতে সেইভ হবে।
ক্যামেরাটির বক্সে পাওয়া যাবে স্বয়ং শাওমি আইপি ক্যামেরা এবং একটি খুবই লম্বা ইউএসবি-টু-মাইক্রো ইউএসবি ক্যাবল আর একটি স্ট্যান্ডার্ড এডাপ্টার। এই দুটি ব্যবহার করে ক্যামেরাটিকে পাওয়ার দেওয়া যাবে এবং দিতে হবে। তবে আমি শাওমির ১০ হাজার এমএএইচ পাওয়ারব্যাংক দিয়ে ক্যামেরাটিকে চালাতে পেরেছি।
সুবিধা এবং ব্যবহারঃ
আপনি অভিভাবক আপনার সারাদিন বাহিরে থাকেন,তাই সন্তান ঘরে কি করছে জানেন না, এবং নজরদারি করতে পারছেন না? আপনি এক্ষেত্রে শাওমি আইপি ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারেন। ঘরের এককোনে ক্যামেরাটি ফিট করে রাখেন,ব্যাস! MiHome অ্যাপলিকেশন দিয়ে যখন খুশি তখন দেখুন, আপনার সন্তানের ঘরে কি হচ্ছে, কি করছে আপনার সন্তান।একইভাবে আপনি যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিসের নজরদারি করতে চান, সেক্ষেত্রে এটি সেটাপ করে রিমোটলি অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর নজরদারি করতে পারবেন।
অন করে রাখলে, ক্যামেরাটি কোন নড়াচড়া বা মুভমেন্ট লক্ষ্য করলে সাথে সাথে স্মার্টফোনে বার্তা তথা নোটিফিকেশন প্রেরন করবে। একইভাবে এর স্মোক ডিটেকটর ফিচার আগুন বা ধোয়া জাতীয় কিছুর সংস্পর্শ পেলে তৎখনাৎ প্রতিক্রিয়াশীল হবে। অন্যসব সিসিটিভি ক্যামেরার মত এর নাইট ভিশন মোডটিও তুলনামূলক ভালো এবং দারুন কার্যকর। ব্যাক্তিগত ব্যবহারে আলোকিত ঘরে বাতি নিভানোর ৪ সেকেন্ড এর মধ্যেই এর নাইটভিশন মোড সয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এইসব ফিচার ছোট্ট এই ডিভাইসটিকে অনেক আকর্ষনীয় করে তুলেছে।
অসুবিধাঃ
যেহেতু এটি একটি ট্রিপিক্যাল আইপি ক্যামেরা, তাই ইন্টারনেট লাগবেই। আপনার বাসা,অফিস বা অন্য কোন জায়গা যেখানে এই ক্যামেরাটিকে সেটাপ করতে চাচ্ছেন – সেখানে অবশ্যই ওয়াইফাই ইন্টারনেটের ভালো কাভারেজ থাকতে হবে। কেননা MiHome দিয়ে ডিভাইসটিকে পেয়ার করার সময় এই ডিভাইসের জন্য Wifi সংযোগ চালু করে দিতে হয়। ধরেন দূরে আছেন, অথচ আপনার ক্যামেরা যেখানে রয়েছে, সেখানে কারেন্ট নেই বা ইন্টারনেট নেই, তবে MiHome অ্যাপে দেখাবে Device Offline সুতরাং ডিভাইস এর সাথে কানেক্টেড হতে পারবেন না। আবার আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, MiHome অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করতে এবং ফুটেজ দেখতে আপনার ডাটা খরচ হবে বা ফোনের ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজনীয় হবে। সুতরাং দুইদিকে পর্যাপ্ত ইন্টারনেটের প্রবাহ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে আপনি MiHome ব্যবহার করে আইপি ক্যামেরাটির পর্যাপ্ত সেবা ও সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
পরিশেষেঃ
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কৃত এবং উৎভাবিত হচ্ছে। আইপি ক্যামেরাও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফসল। আর দারুন এই আইপি ক্যামেরা প্রযুক্তির ধারায় তৈরি সুন্দর একটি পোর্টেবল ক্যামেরার সুবিধা ও রিভিউ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে তুলে ধরা হল। ভালো লাগলে শেয়ার করবেন, নিচে মতামত জানাতে ভুলবেন না।ধন্যবাদ