আজকের এই বর্ধমান ইন্টারনেটের জগতে “ব্যান্ডউইথ” একটি অতি পরিচিত টার্ম—যদিও এই টার্মটির কতিপয় টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা রয়েছে, কিন্তু ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতোটুকু ডাটা ইউনিট ট্র্যান্সমিট হবে এই পরিমাপকে ব্যান্ডউইথ বলা হয়। ব্রডব্যান্ডের সাথে ফিজিক্যাল অ্যাক্সেস ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, কিন্তু অনেক টাইপের ম্যাথড ব্যবহার করে বর্তমানে ইন্টারনেট কানেকশন পেতে পারেন। শুধু ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই হবে না, হাই-ব্যান্ডউইথ রেটও থাকতে হবে। একটি ভিডিও হাই-ব্যান্ডউইথ রেটের কানেকশনে যতোদ্রুত লোড হবে, লো-ব্যান্ডউইথ কানেকশনের ততোদ্রুত লোড হতে পারবে না। যদি এক কথায় প্রকাশ করতে চাই, তাহলে প্রতি সেকেন্ডে কতো বিট ডাটা ট্র্যান্সফার করা হয় এই টার্মকেই ব্যান্ডউইথ বলা হয়, যেমন- ৮ মেগাবিট/সেকেন্ড (8Mbps), এখানে প্রতি সেকেন্ডে ৮ মিলিয়ন বিট ট্র্যান্সফার করা যাবে।
ব্যান্ডউইথ পরিমাপ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার কাছে কতোটুকু ব্যান্ডউইথ রয়েছে? কিভাবে পরিমাপ করবেন? অনেকে বলবে, “এটা তো অনেক সহজ কাজ, সিমের নির্দিষ্ট কোড ডায়াল করলেই তো বলে দেয় কতো ব্যান্ডউইথ রয়েছে, আর ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করলে আন-লিমিটেড ব্যান্ডউইথ থাকে”। আসলে আপনি সম্পূর্ণই ভুল—আপনার সিম ডাটা অ্যাকাউন্টে যতো ডাটা প্রদর্শিত করানো হয়, সেটা হচ্ছে জাস্ট একটা লিমিট, অর্থাৎ আপনি মোট কতোটুকু ব্যান্ডউইথ খরচ করতে পারবেন। কিন্তু যদি বলা হয় আপনার ব্যান্ডউইথ কতো, সেক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যান্ডউইথ রেট জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
ব্যান্ডউইথ-রেট পরিমাপ করার জন্য অনেক স্পীড টেস্ট ওয়েবসাইট রয়েছে, যেগুলো স্বাভাবিক ভাষায় বলতে আপনার ইন্টারনেট কানেকশন স্পীড টেস্ট করে। যখন আপনি কোন স্পীড টেস্ট ওয়েবসাইটে স্পীড টেস্ট আরম্ভ করেন, আপনার কম্পিউটার থেকে সার্ভার কম্পিউটার পর্যন্ত ডাটা ট্র্যান্সমিট এবং সার্ভার থেকে আপনার কম্পিউটার পর্যন্ত ডাটা ট্র্যান্সমিট রেট পরিমাপ করে আপনাকে একটি রেজাল্ট প্রদান করা হয়। কিন্তু কখনোই একদম ঠিকঠাক রেজাল্ট পাওয়া সম্ভব নয়। আপনি এভারেজ রেজাল্ট পেতে পারেন এবং সেখান থেকে ধারণা নিতে পারেন। ইন্টারনেটে কোন সার্ভারের সাথে কানেক্ট হয়ে ডাটা ট্র্যান্সফার করছেন, এতে ঐ সার্ভারটির ফিজিক্যাল লোকেশন কোথায়, ডাটা ট্র্যান্সফার-রেট সেটার উপরও নির্ভর করে। আপনি বাংলাদেশ বা এশিয়ান সার্ভার থেকে যতোদ্রুত ফাইল ডাউনলোড করতে পারবেন, অ্যামেরিকা বা ইউরোপের সার্ভার থেকে ততোদ্রুত ফাইল ডাউনলোড করতে পারবেন না। কেনোনা পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে ডাটা কখনোই আলোর গতির চেয়ে দ্রুত ট্র্যাভেল করতে পারে না। হ্যাঁ, আলোর গতি অনেক (১৮৬,০০০ মাইল/সেকেন্ড), কিন্তু তারপরেও এর একটি লিমিটেশন রয়েছে, মানে সেকেন্ডে কেবল ১৮৬,০০০ মাইলই অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে, তাই সার্ভার আপনার লোকেশন থেকে দূরে হলে অবশ্যই ট্র্যান্সফার স্পীডের উপর পার্থক্য আসবে।
সাধারণত, ডাউনলোড স্পীড আপলোড স্পীড থেকে বেশি ভালো হয়ে থাকে, কিন্তু কেন? কারণ বেশিরভাগ ইন্টারনেট ইউজার সার্ভার থেকে ফাইল ডাউনলোড বেশি করে থাকে, কিন্তু সার্ভারে ফাইল আপলোড অনেক কম হয়। তাই আইএসপি’রা আপলোড স্পীড কমিয়ে রাখে। কিন্তু সার্ভারে যে ইন্টারনেট কানেকশন থাকে, সেখানে আপলোড স্পীড বেশি থাকে, আর এই জন্যই আপনি সার্ভার থেকে ডাউনলোড স্পীড বেশি পান। কেনোনা যখন আপনি সার্ভার থেকে কোন ফাইল ডাউনলোড করেন, অবশ্যই সেই সময় সার্ভার আপনাকে ফাইলটি আপলোড করছে।
স্পীডটেস্ট ডট নেট বা ফাস্ট ডট কম স্পীডটেস্ট সাইট গুলো ব্যবহার করে আপনার এভারেজ ব্যান্ডউইথ চেক করতে পারেন। অনেক আইএসপি নিজস্ব ব্যান্ডউইথ টেস্টার প্রদান করে থাকে, আপনি সেটাও ব্যবহার করে আপনার ব্যান্ডউইথ স্পীডের ধারণা নিতে পারেন। একদম ঠিকঠাক স্পীড পাওয়া সম্ভব নয়, কেনোনা এতে অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে, যেগুলো উপরে আলোচনা করলাম।
ব্যান্ডউইথ Vs পানির নল
ব্যান্ডউইথ টার্মটিকে বোঝার জন্য, একে আপনি পানির নলের বা ট্যাপের সাথে তুলনা করতে পারেন। যদি ট্র্যান্সফার রেট বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আরো দ্রুত পানি প্রবাহিত হতে আরম্ভ করবে। একটি পানির পাইপে অবশ্যই লিমিট থাকে, আপনি একটি সময়ের মধ্যে কতোটুকু পানি প্রবাহিত করতে পারবেন।
এবার ধরুন আপনি ব্রডব্যান্ড কানেকশন থাকে মুভি ডাউনলোড করছেন, ঐ কানেকশন থেকেই ভিডিও স্ট্রিমিং করছেন, ম্যাল্টি প্লেয়ার গেমিং করছেন, ভিওআইপি কলিং করছেন—এভাবে আপনি যতো বেশি দিক থেকে ব্যান্ডউইথ খরচ করতে থাকবেন আপনার কানেকশন ততো স্লো হয়ে যাবে। এবার পানির নলের উদাহরন নেওয়া যাক, আপনার বাড়িতে একটি প্রধান পানির নল রয়েছে যেটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমানে পানি ট্র্যান্সফার করার ক্ষমতা রাখে। এখন আপনি যদি কিচেনের নল, বাথরুমের নল, বাগানের নল এক সাথে ছেড়ে রাখেন সেক্ষেত্রে পানির স্পীড সকল নলেই কম হয়ে যাবে। কেনোনা সোর্স পানির প্রেসারের উপর ভিত্তি করেই সকল নল গুলো স্পীড প্রদান করবে। তো ব্যান্ডউইথ স্পীড সম্পর্কে পরিষ্কার বুঝতে পারলেন?
এবার আরেকটি টার্ম রয়েছে, বিশেষ করে মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে আপনি কতো টাকা পে করছেন তার অনুসারে আপনাকে ব্যান্ডউইথ পরিমান ফিক্স করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আপনাকে দুইটি জিনিষ চিন্তা করে চলতে হয়, প্রথমত আপনি ঐ নেটওয়ার্ক থেকে শুধু নির্দিষ্ট পরিমানেই ডাটা ট্র্যান্সফার করতে পারবেন (১ জিবি বা ২ জিবি বা আপনি যতোটুকু ডাটা ট্র্যান্সফার করার জন্য পরিশোধ করেছেন), আবার আপনার এখানেই ব্যান্ডউইথ-রেট ফ্যাক্টর রয়েছে, ঠিক প্রত্যেক সেকেন্ডে আপনি কতো গুলো বিট ডাটা ট্র্যান্সফার করতে পারবেন (১০ মিলিয়ন বিট/সেকেন্ড)। ব্যান্ডউইথ রেটকে মেগাবিট/সেকেন্ড (Mb/s) হিসেবে গণনা করা হয়, আর ফাইল সাইজকে মেগাবাইট (MB) হিসেবে গণনা করা হয়। এজন্যই আইএসপি থেকে ইন্টারনেট কেনার সময় তারা ১ মেগাবিট/সেকেন্ড (1Mbps) এভাবে প্ল্যান বিক্রি করে, কিন্তু ফাইল ডাউনলোড করার সময় আপনি কেবল ~১২৫ কিলোবাইট/সেকেন্ড (~128 KB/s) স্পীড পেয়ে থাকেন। কেনোনা বিট এবং বাইট দুইটি আলাদা পরিমাপ। ১ বাইটের মধ্যে ৮টি বিট থাকে, অর্থাৎ আপনার রেটিং করা কানেকশন মেগাবাইটের ক্ষেত্রে ৮ গুন ছোট হয়ে থাকবে।
মেগাবাইট/সেকেন্ড Vs মেগাবিট/সেকেন্ড
ব্যান্ডউইথ রেটকে বিট/সেকেন্ড দ্বারা স্বাভাবিকভাবে নির্ণয় করা হলেও আপনাকে এটা জানতে হবে যে, যেকোনো ইউনিট দ্বারা ব্যান্ডউইথ রেটকে রেটিং করা সম্ভব যেমন- কিলোবিট/সেকেন্ড (Kb/s), কিলোবাইট/সেকেন্ড (KB/s), মেগাবিট/সেকেন্ড (Mb/s), মেগাবাইট/সেকেন্ড (MB/s), গিগাবিট/সেকেন্ড (Gb/s), গিগাবাইট/সেকেন্ড (GB/s)। আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার যেকোনো একটি টার্ম ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু আপনার স্পীড টেস্টিং সার্ভিস আলাদা টার্ম, ভিডিও ওয়েবসাইট আলাদা টার্ম, ডাউনলোডিং সফটওয়্যার আলাদা টার্ম ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আপনি যদি এই টার্ম গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন, সেক্ষেত্রে এটা ভেবে চিন্তিত হতে হবে না, কেন আলাদা আলাদা জায়গায় আলাদা আলাদা স্পীড প্রদর্শিত হচ্ছে।
যেমন ধরুন, ১০ মেগাবাইট/সেকেন্ড (MB/s) আর ১০ মেগাবিট/সেকেন্ড (Mb/s) কিন্তু এক জিনিষ নয়। এখানে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন মেগাবিটে (b ছোট হাতের) এবং মেগাবাইটে (B বড় হাতের), এর সাহায্যের সহজেই মেগাবিট আর মেগাবাইট নির্ণয় করতে পারবেন। যেহেতু ৮ বিটে ১ বাইট সুতরাং বাইট, বিট থেকে ৮ গুন বড়! যদি অপারেটর ৮ মেগাবিট/সেকেন্ড (8 Mb/s) ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে, এর মানে মেগাবাইটে আপনি ৮÷৮ = ১ মেগাবাইট/সেকেন্ড (1 MB/s) স্পীড পাবেন।
ব্যান্ডউইথ রেট আরো বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন লেটেন্সি, ডাটা প্যাকেট লস, একটি প্যাকেট থেকে আরেকটি প্যাকেট রিসিভ হওয়ার সময়ের পার্থক্য। যাই হোক, এই সম্পূর্ণ আর্টিকেল থেকে আশা করছি ব্যান্ডউইথ নিয়ে সকল দ্বিধাদন্দ আপনার মন থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। যদি এখনো কোন প্রশ্ন থাকে, অবশ্যই আমাকে নিচে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না!