সংষ্কৃতে একটি শ্লোকে বলা আছে, ফল লাভ করতে সবাই চায় কিন্তু ফল লাভ করার জন্য যে পরিশ্রমের প্রয়োজন সেইটি কেউ করতে চায়না।
সহজ করে বলতে গেলে বিনা পরিশ্রমে সফলতা চাওয়া।
কিন্তু কথাতেই আছে, কষ্ট করলে কেষ্ট মিলবে। তারমানে হল বিনা পরিশ্রমে কখনোই সফলতা আসে না।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল কিভাবে নিজেদের পরিশ্রমী করে তোলা যায় ? নিজেদের পরিশ্রমী করে তোলার জন্য খুব সহজ কয়েকটি পন্থা আছে, এই জীবনের পথ সবসময় মসৃণ হয় না।
চড়াই উতরাই তো লেগেই আছে। জীবনে পরিশ্রমী না হলে খারাপ পরিস্থিতি থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে পারা যাবে না।
জীবনে কেন পরিশ্রমী হতে হবে ?
এখন জানতে হবে, জীবনে কেন পরিশ্রমী হতে হবে ? এর উত্তর না জানলে পরিশ্রমী হওয়া যাবে না।
১] এই জীবনের পথ সব সময় মসৃণ হবে এমনটা নয়। জীবনের পথে চড়াই উতরাই লেগেই থাকবে, পরিশ্রমী না হলে সহজেই দুর্দিনে মনোবল হারিয়ে ফেলব, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ব।
তাই জীবনে পরিশ্রমী হওয়া বা পরিশ্রমী মনোভাব পোষন করা খুব জরুরি।
এটি আমাদের দুর্দিনেও এগিয়ে যাবার সাহস যোগাবে, মনোবল যোগাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেবে না এবং সাফল্য এনে দেবে।
২] জীবনে যেকোনো ধরনের সফলতার জন্য চাই সংগ্রাম। জীবন সংগ্রামে পরিশ্রমী মনোভাব খুব জরুরি।
সবক্ষেত্রে জয় আসবে এমন নয়, ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে হবে। তবে ব্যর্থতায় হতাশ হলে চলবে না।
জীবন সংগ্রামে পরিশ্রমী মনোভাব ব্যর্থতা থেকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কখনোই জীবন কে হতাশাগ্রস্থ করে তুলবে না।
৩] সফলতা অর্জনের অন্য পন্থা হল পরিশ্রমী মনোভাব।
যেকোনো কাজ পরিশ্রমের সাথে করলে কাজটি কখনোই বোঝা হয় না উল্টে কাজটি অনেক সহজ মনে হয় তখন কাজ করার সময় আনন্দ হয় এবং খুব কম সময়ে নিখুঁত ভাবে কাজটি শেষ হয়।
পরিশ্রমী মনোভাব দ্রুত সফলতা এনে দেয় বা নিজেদের লক্ষ্যে পৌছে দেয়।
কবি কৃষ্ণদয়াল বসুর একটি কবিতার সারাংশ
পরিশ্রমীরাই সফলতা পায়, এই প্রসঙ্গে কবি কৃষ্ণদয়াল বসুর একটি কবিতার সারাংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন।
একটা রাস্তার ধারে বেশ বড়ো মাপের পাথর পড়ে ছিল, কেউ সেই পাথরটা সরায় না।
ওই ভাবেই পাথরটাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটে, অন্ধকারে হোঁচট খায়, এই ভাবে দিন যায়।
একদিন এক শ্রমিক রাগে পাথরটাকে দুহাতে তুলে কিছুটা দূরে ফেলে দেয়।
পাথরটা ভেঙে গেলে তার ভিতর থেকে সোনার মোহর ভরা একটা কৌটো শ্রমিকটি পায় যাতে মোহরের সাথে একটা কাগজে লেখা ছিল,
“পথিক তুমি পরিশ্রমী লও এ সোনার কলস
কঠিন শ্রমের এই তো পুরষ্কার “।
অলস জীবন ব্যর্থতার জীবন। শুধু চিন্তা ভাবনা করলে কখনোই দুঃসময় কেটে যায় না।
অন্ধকার ঘরে যেমন কোনো জিনিস না পেলে আশা ছেড়ে না দিয়ে বেশি করে খুঁজতে হয় তেমনি জীবনের প্রত্যেক মুহুর্তে সফলতার জন্য পরিশ্রম করতে হয়।
পরিশ্রমী হওয়ার উপায় গুলো – সেরা ৬ টি উপায়
নিজেদের পরিশ্রমী করে তুলতে গেলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি গুলি অনুসরন করা যেতে পারে
১) যেকোনো কাজ করার সময়, সেই কাজটি নিয়েই চিন্তা করা
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি কাজ করার সময় অন্য কথা বা অন্য প্রসঙ্গ মনে পড়ে যাচ্ছে।
এর মানে হল কাজে মন নেই বা কাজে অমনোযোগী।
ধরা যাক এই লেখাটি কেউ পড়ছে, পড়তে পড়তে সে হয়তো অন্য কিছু ভাবছে। তার মানে তার মন আর পড়ায় নেই।
যেকোনো কাজ করার সময় মনে দিয়ে কাজ করতে হবে। কাজটির সঙ্গে একাত্ম হতে হবে।
তবে কাজটি করা যাবে। কাজের প্রতি অনীহা বা কাজ করার ইচ্ছে যদি আসে তাহলে পরিশ্রমী হয়ে ওঠা যাবে।
কাজ করতে করতে কাজ করার অভ্যাস আসবে।
অভ্যাস কাজ করার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে। কাজকে ভালোবাসলে তবে পরিশ্রমী হয়ে ওঠা যাবে।
মাল্টি টাস্কিং হওয়া বা এক সময়ে একাধিক কাজ করতে পারা একটি ভালো গুন।
তবে কেউ যদি নিয়মিত একসাথে অনেক কাজ করার চেষ্টা করে, তাহলে কিন্তু বুঝতে হবে সে মানসিক ভাবে চঞ্চল এবং যেকোনো একটি কাজ সম্পূর্ণ রূপে শেষ করার আগেই সে অন্য একটি কাজ করার চেষ্টা করছে।
মানসিক চঞ্চলতা দ্রুত ক্লান্ত করে দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মস্তিষ্ক একই সময়ে একটির বেশি কাজে ফোকাস করতে পারে না।
একাধিক কাছে মনোনিবেশ করলে মানসিক ক্লান্তির সাথে শারীরিক ক্লান্তিও অনুভূত হয়।
তাই সব সময়ে চেষ্টা করতে হবে যেন একটি সময়ে একটি মাত্র কাজে ফোকাস করা হয়।
একটি কাজ শেষ করে তারপর আর একটি কাজ আরম্ভ করা যেতে পারে।
এই রূপ কাজ করার চিন্তাভাবনা পরিশ্রমী মানসিকতা গঠনের জন্য উপকারী।
২) বড়ো কাজকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা
যখন খুব বড় কোনও কাজ করা হয় অনেক সময় দেখা যায় একটানা কাজ করতে করতে কাজে বিরক্তি আসে, ভুল হয়ে যায়।
যেকোনো কাজ করার সময় মানুষের মস্তিষ্কে চাপ পড়ে।
অনেকক্ষন ধরে কাজ করলে মস্তিস্কের চাপ অনেক বেড়ে যায় তখন মানসিক ক্লান্তিবোধ হয়, শুধু তাই নয় অনেকক্ষন কাজ করলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রেও চাপ পড়ে।
তাই দীর্ঘক্ষণ সময়ের কোনো কাজ একনাগাড়ে করলে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যেতে হয় এবং কাজ করার মানসিকতা থাকে না।
তাই কাজের মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়া দরকার বা কাজটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে করা উচিত।
এতে কাজ করার উদ্যোম বাড়ে এবং পরিশ্রমী মনোভাব বজায় থাকে।
কেউ যদি ৪৫ মিনিট একটানা কোনো কাজ করে তাহলে সে ১৫ মিনিটের একটি ব্রেক নিতে পারে।
প্রথমে নিজেকে পরিশ্রমী করে তুলতে গেলে কাজ করার ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। দীর্ঘক্ষণ কাজ নয় কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
৩) নিয়মিত রুটিন ফলো করে কাজ করুন
কাজ করার আগে তার জন্য পরিকল্পনা করা যেতে পারে সাথে সাথেই নিয়মিত রুটিন ফলো কাজ করতে হবে।
ফলে প্রতিটা কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকবে, তার মধ্যেই সম্পূর্ণ কাজটি করতে হবে এইভাবে যদি কেউ রুটিন মেনে কোনো কাজ করে তাহলে তার মধ্যে যেমন নিয়মানুবর্তিতা বৃদ্ধি পাবে তেমনি সে পরিশ্রমী হয়ে উঠবে।
যদি কোনো কাজের জন্য ধরা যাক আধ ঘন্টা সময় বরাদ্দ তাহলে সে চেষ্টা করবে কাজটি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার।
এই সময় সে কাজ ছাড়া অন্য কোনো দিকে ভাববে না। সাথে সাথেই সে নিজের সম্পূর্ণ পরিশ্রম দিয়ে কাজটি করবে।
তাই কাজের রুটিন তৈরি করা ভালো। যদি কেউ নিজের সম্পূর্ণ পরিশ্রম নিজের কাজে দেয় তাহলে সে দ্রুত সফল হবে।
অনেক সময় দেখা যায় কাজে অমনোযোগী হয়ে সে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকক্ষণ সময় নষ্ট করেছে ফলে কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গিয়েছে।
এখন সে যদি পরিশ্রম করে তাহলে তা ব্যর্থ। তাই রুটিন ফলো করে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি।
৪) নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে
স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন ভগবৎ গীতা পড়ার থেকে ফুটবল খেলা অনেক ভালো।
পরিশ্রমী মনোভাবের জন্য চাই স্পোর্টস ম্যান স্পিড। খেলাধূলা না করলে দৃঢ় এবং পরিশ্রমী মনোভাব আসবে না।
হয়তো কোনো পদক্ষেপে কেউ ব্যর্থ হল তার যদি দৃঢ় এবং পরিশ্রমী মনোভাব না থাকে তাহলে সে হতাশাকে কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
পৃথিবীর সবথেকে ভালো গোলকিপারও কোনোদিন গোল খেয়েছে, সবথেকে ব্যাটসম্যান শূন্যতে আউট হয়েছে।
কিন্তু কেউ হার মানেনি। খেলাধূলা দৈহিক এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে। মানসিক ভাবে সক্রিয় করে তোলে, পরিশ্রমী করে তোলে।
খেলাধূলা হার মানতে শেখায় না। ফলাফল যাই হোক ম্যাচের শেষ অবধি লড়াই করে যেতে হবে।
ঠিক তেমনি এই জীবন একটা খেলার ময়দান। হার-জিত, সফলতা – ব্যর্থতা এইসব লেগেই থাকবে কিন্তু এইসব না ভেবে এগিয়ে যেতে হবে।
পরিশ্রম করতে হবে।
৫) পুষ্টিকর, পর্যাপ্ত আহার গ্রহণ
একজন শিশুর যা উপযোগী খাদ্য, একজন বৃদ্ধের জন্য তা উপযোগী নয়।
তেমনি একজন সুস্থ মানুষের আহার যা হয় অসুস্থ লোকের আহার তা নয়।
মানুষের কর্মজীবনে আহারের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।
একজন পরিশ্রমী মানুষকে সুষম, পুষ্টিকর আহার গ্রহণ করা উচিত। যা তার শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন, শর্করা ইত্যাদি সরবরাহ করবে।
তাই খাদ্যাভাসে সবুজ শাকসবজি; প্রাণীজ প্রোটিন যেমন মাছ, মাংস, ডিম, উদ্ভিদজ প্রোটিন যেমন বিভিন্ন ডাল, সোয়াবিন গ্রহন করা অত্যন্ত জরুরি।
এমন কিছু কিছু খাবার আছে – যা মুখের স্বাদে খেতে ভালো হলেও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর ।
উদাহরন হিসাবে রিচ ফুড, এগুলি শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
এর ফলে দৈহিক ওজন আর স্থূলতা বেড়ে যায় – এবং অল্প পরিশ্রম করলেই ক্লান্তি আসে।
অনেকেই সকালে টিফিন করার সময় পায় না। সকালে টিফিন করলে সারাদিন কাজ করার আগ্রহ থাকে।
মনে রাখতে হবে শুধু সুষম পুষ্টিকর খাদ্য খেলেই চলবে না নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর তা খেতে হবে।
একসাথে অনেক পরিমাণ খাওয়ার খেলে দ্রুত ক্লান্তি আসে। তাই দিনে চারটি ধাপে খাবার খাওয়া উচিত।
সকাল এবং বিকালে টিফিন দুপুর এবং রাতে সম্পূর্ণ আহার তবে রাতে দুপুরের কিছুটা কম খাওয়া উচিত।
অনেকেই কাজের ফাঁকে এনার্জির জন্য পরিমান চা-কফি, কোকো খেয়ে থাকে।
অল্প সময়ের জন্য মানসিক ভাবে এটি ক্লান্তি দূর করলেও এগুলির অধিক পান শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।
প্রত্যেকদিনে গড়ে ২.৫ -৩ লিটার জল পান করা উচিত।
যত বেশি জল খাওয়া যাবে, কিডনির ওপর চাপ তত কমবে এবং শরীরের দূষিত পদার্থ শরীর থেকে অপসারিত হবে।
৬) দৈনিক ঘুম এবং বিশ্রাম
অনেকেই আছে যারা নিজেদের অধিক পরিশ্রমী বানানোর জন্য বিশ্রাম ও ঘুমকে গুরুত্ব দিতে চায় না।
কিন্তু এটা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার মানসিকতা পরিশ্রম করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দিতে পারে।
সারাদিন পরিশ্রম করার জন্য রাতে ঠিকমত ঘুম দরকার। বিশ্রাম হিসাবে ঘুমের কোনও বিকল্প নেই।
ঠিকমত না ঘুমিয়ে যদি কেউ টানা অনেকদিন পরিশ্রম করে তাহলে দেখা যাবে কিছুদিন পর তার আর পরিশ্রম করার মানসিকতা নেই।
শুধু তাই নয় অপর্যাপ্ত ঘুম ডেকে আনতে পারে মানসিক অবসাদ এবং অসুখ।
কারণ, সময়মত বিশ্রাম না নিয়ে যখন অধিক কাজ করা হয় তখন শরীরের ওপর চাপ বৃদ্ধি হয়।
এভাবে কিছুদিন চলতে থাকলে শরীর তার কাজ করার স্বাভাবিক শক্তি হারিয়ে ফেলবে, এবং সেই শক্তি উদ্ধার হওয়ার আগে পর্যন্ত আর কঠোর পরিশ্রম করতে পারা যাবে না।
কাজেই, প্রতিদিনের কাজের শেষে অবশ্যই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের রাতে ৮ ঘন্টা ঘুমানো উচিৎ। তা না হলেও কম করে ৬ ঘন্টা ঘুমানো উচিত।
আর একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, বেশি রাত করে ঘুমাতে যাওয়া ঠিক নয়। চেষ্টা করতে হবে রাত ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার এবং সকাল ৬-৭টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠার।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে শরীর এবং মন দুটোই ফ্রেশ থাকে। কাজ করার শক্তি পাওয়া যায়।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস না করতে পারলে কাজের সময়ে শরীর ও মস্তিষ্ককে পূর্ণ মাত্রায় খাটাতে পারা যাবে না।
ছোটোবেলায় প্রায় সবাই পড়েছিলাম –
“আর্লি দু বেড অ্যান্ড আর্লি দু রাইস
মেকস্ এ ম্যান হেল্দি, ওয়েল্দি অ্যান্ড ওয়াইস।”
আমাদের শেষ কথা,,
তাহলে বন্ধুরা, আমাদের আজকের “পরিশ্রমী হওয়ার উপায়” বা “কিভাবে পরিশ্রমী হওয়া যায়” নিয়ে লিখা আর্টিকেলটি যদি সত্যি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তাহলে আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার অবশই করবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে নিচে কমেন্ট করে অবশই জানাবেন।