মোবাইল প্রসেসর বৃত্তান্ত | আপনি কোন প্রসেসরটি নির্বাচন করবেন?
আপনার কোন প্রসেসরটি নির্বাচন করা উচিৎ?
আপনার কাছে একটি কোয়াডকোর প্রসেসর ফোন এবং আপনার বন্ধুর কাছে অক্টাকোর প্রসেসর ফোন আছে, এর মানে কি আপনার ফোন আপনার বন্ধুর ফোনের চেয়ে দুর্বল? আজকের পোস্টে মোবাইল প্রসেসর এর কমন টার্ম গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। এবং জানবো শুধু কি, কোয়াডকোর প্রসেসর বা অক্টাকোর প্রসেসর কিংবা বেশি গিগাহার্জ হলেই ভালো প্রসেসর হয়? তাছাড়াও আপনি মোবাইল ফোন কেনার সময় প্রসেসরের দিকে কোন বিষয় গুলোর উপর বেশি খেয়াল রাখবেন, তা নিয়ে আলোচনা করবো। তো আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলুন শুরু করা যাক।
মোবাইল প্রসেসর
মোবাইল প্রসেসর মূলত চারটি বড় কোম্পানি বানিয়ে থাকে। কোয়ালকম, মিডিয়াটেক, স্যামসাং এবং এনভিডিয়া। এখন এই চার কোম্পানিকে প্রসেসর বানাতে যে নকশার প্রয়োজন পড়ে অর্থাৎ আর্কিটেকচার এর প্রয়োজন পড়ে, তা আর্ম নামক একটি কোম্পানি লাইসেন্স এর সাথে সরবরাহ করে। আপনি যখনই একটি নতুন ফোন কেনার চিন্তা করেন তখনই আপনার মনে অবশ্যই ৩ টি বিশেষ চিন্তা আসে। একটি হলো আপনার ফোনটি ল্যাগ করবে কিনা? দ্বিতীয়ত ফোনটি কতটা গরম হতে পারে? এবং তৃতীয়ত ফোনটির ব্যাটারি লাইফ ভালো হবে কি না? এবং টেকনিক্যালি এই তিনটি কথাই কোথাও না কোথাও যুক্ত থাকে ফোনটির প্রসেসরের সাথে। তাছাড়া আপনি যখনই দুইটি বা তিনটি ফোনের মধ্যে তুলনা করেন তখন দেখেন যে, ফোনটির প্রসেসর ডুয়ালকোর? না কোয়াডকোর প্রসেসর? না অক্টাকোর। এবং এদের ফ্রিকুএন্সি কার কত বেশি! আর আমাদের মানুষ জাতির তো একটা মূল মন্ত্র আছেই যে বেশি নাম্বার মানে বেশি ভালো জিনিস। তাই তো আমরা সর্বদা ভেবে দেখি যে অক্টাকোর প্রসেসর কোয়াডকোর প্রসেসর থেকে বেশি ভালো এবং ২ গিগাহার্জ ফ্রিকুএন্সি ১.৫ গিগাহার্জ ফ্রিকুএন্সি থেকে ভালো। আর এই মূলমন্ত্রের সাথে চিপকে লেগে থাকার জন্য জেনে বা অজান্তে আমরা ভুল করে থাকি এবং ভুল প্রসেসর নির্বাচন করে ফেলি।
যেকোনো প্রসেসরের মধ্যে তুলনা করার আগে ৪ টি বিষয়ের উপর বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজনীয়। এই বিষয় গুলো ছাড়া আপনি কখনোয় একটি প্রসেসর এর সাথে আরেকটির তুলনা করতে পারবেন না। শুধু কোয়াডকোর বা অক্টাকোর হওয়াতে কোন পার্থক্য হয় না। এছাড়াও অনেক বিষয় আছে এবং আমি আপনাদের সাথে তা নিয়ে এখন আলোচনা করবো।
(কম্পিউটারের সকল প্রসেসর সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন, কোর আই৩, কোর আই৫, কোর আই৭ | আপনার কোনটি কেনা উচিৎ?)
১/ আর্কিটেকচার
সর্ব প্রথম বিষয়টি হলো প্রসেসরটির আর্কিটেকচার বা নকশা। আমি আগেই বলেছি প্রসেসর প্রস্তুতকারী কোম্পানিদের আর্ম নামক একটি কোম্পানি লাইসেন্স এর সাথে আর্কিটেকচার ডিজাইন সরবরাহ করে থাকে। এবং এই কোম্পানিটির আর্কিটেকচার ডিজাইন বছরের পর বছর ধরে উন্নত হতেই চলেছে। যেমন প্রথমে কর্টেক্স এ৫ ছিল তারপর এ৭, এ৯, এ১১, এ১৫, এ৫৩, এ৫৭, এ৫৯ ইত্যাদি। আপনি ভাবতে পারেন এগুলো কি এবং এগুলো দিয়ে কি হবে? দেখুন সহজ বাংলা ভাষায় বুঝতে নাম্বার যতো বেশি হবে ততো ভালো ডিজাইন আপনি দেখতে পাবেন। যেমন কর্টেক্স এ৫৭ এ৫৩ থেকে উন্নত অথবা কর্টেক্স এ১৫ এ৯ থেকে উন্নত। অর্থাৎ প্রসেসর শুধু কোয়াডকোর বা অক্টাকোর হলেই হবে না দেখতে হবে যে এই প্রসেসরে কোন আর্কিটেকচার ডিজাইন ব্যবহার করা হয়েছে।
২/ টেকনোলজি
দ্বিতীয়ত কথা আসে টেকনোলজির। অর্থাৎ সেই প্রসেসরটি বানাতে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তার। দেখুন একটি প্রসেসরে ছোটছোট লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ট্রানজেস্টর লাগানো থাকে। এখন একেকটি ট্রানজেস্টরের আকার যতো ছোট হবে, প্রসেসর ততো দ্রুত কাজ করতে সক্ষম হবে এবং তো বেশি ব্যাটারি সেভ করবে। এখানে কি হয়, প্রসেসর প্রস্তুতকারী কোম্পানিগন আর্ম থেকে যে আর্কিটেকচার ডিজাইন পায় তা নিজেদের ইচ্ছা মতো হিসেবে এবং টেকনোলজি অনুসারে ট্রানজেস্টর ছোট এবং বড় হিসেবে তৈরি করে। বর্তমানে স্যামসাং সেই হিসেবে প্রথম স্থানে রয়েছে। স্যামসাং তাদের নিজস্ব টেকনোলজি ব্যবহার করে সবচাইতে ছোট ট্রানজেস্টর বানিয়ে ফেলেছে। এবং এর সাইজ ১৪ ন্যানোমিটার। কোয়ালকম এর সাইজ ২০ ন্যানোমিটার, মিডিয়াটেক কখনো ২৬ কখনো ২৮ ন্যানোমিটার ট্রানজেস্টর তৈরি করে। তো আপনার প্রসেসরের ট্রানজেস্টর গুলোর সাইজ যতো ছোট হবে আপনি ততোবেশি কার্যক্ষমতা দেখতে পাবেন এবং আপনার প্রসেসরের স্পীড ততো বেশি হবে।
৩/ প্রসেসরের কোর সংখ্যা
তৃতীয়ত যে বিষয়টি এসে থাকে তা হলো নাম্বার অফ কোরস। অর্থাৎ প্রসেসরের কোর সংখ্যা। এখন এই কোর জিনিসটা কি? চলুন সহজ ভাষায় বুঝবার চেষ্টা করি কোর সম্পর্কে। মনে করুন আমি একটি প্রসেসর, এবং আমার দুইহাত হলো আমার দুইটি কোর। যেহেতু আমার কাছে দুটি কোর অর্থাৎ দুটি হাত আছে সুতরাং আমি দুইটি কাজ একসাথে করতে পারবো। এখন কোনো প্রসেসর যদি কোয়াডকোর হয় তবে এর মানে হলো এর কাছে চারটি হাত রয়েছে। চার হাত মানে একসাথে সে চারটি কাজ করতে পারবে। আরেকটি প্রসেসর হলো অক্টাকোর, অর্থাৎ এর ৮ টি হাত রয়েছে। অর্থাৎ সে ইচ্চামত আরামছে যেকোনো কাজ করতে পারবে। এখন ভেবে দেখুন যে একটি কাজ যদি আমি দুই হাতে করি এবং একই কাজ যদি ৮ হাতে করা হয় তবে সে কাজটি কত তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কোর হলো প্রসেসরের একেকটি হাত। যা একসাথে মিলে বা আলাদা আলদা করে এক কাজকে অনেক সহজে অনেক দ্রুত সম্পূর্ণ করতে পারে। এবং এর ফলে প্রসেসর গরমও কম হয়। তো কোয়াডকোর এবং অক্টাকোর প্রসেসরের ক্ষেত্রে অক্টাকোর উত্তম হবে। কিন্তু অক্টাকোর তখনই উন্নত হবে যখন এর আর্কিটেকচার এবং বানানোর প্রযুক্তির সমান একতা থাকবে। যদি এই বিষয় গুলো আলদা আলাদা হয় তবে আপনি কখনই বলতে পারবেন না যে কোয়াডকোর বেশি ভালো না অক্টাকোর বেশি ভালো।
৪/ ফ্রিকুএন্সি (গিগাহার্জ)
দেখুন সর্বশেষে যে জিনিসটি আসে তা হলো গিগাহার্জ। অমুক প্রসেসর ২ গিগাহার্জ, তমুক প্রসেসর ১.৫ গিগাহার্জ। তো গিগাহার্জ এর মানে টা কি? দেখুন প্রত্যেকটি প্রসেসরের সাথে একটি ঘড়ি লাগানো থাকে। এবং সেই ক্লক বা ঘড়ির টাইমিং এর সাহায্যে প্রসেসর কাজ করে থাকে। এখন ১ গিগাহার্জ প্রসেসরের মানে হলো এই প্রসেসর ১ সেকেন্ডে ১০ কোটিবার কাজ করবে। এখন একটি কাজ করতে একটি প্রসেসরকে কত গুলো ওয়ার্ক সাইকেল ব্যবহার করতে হবে তা নির্ভর করে প্রসেসরটির উপর এবং কাজটির উপর। প্রসেসরের ১ বার কাজ করার সময়কে একটি ওয়ার্ক সাইকেল ধরা হয়।
আপনার কোন প্রসেসরটি নির্বাচন করা উচিৎ?
আসল কথা হলো আপনি যখনই কোন মোবাইল প্রসেসর কে তুলনা করতে যাবেন তখন চেক করে দেখুন এটি কোন আর্কিটেকচার ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনি হয়তো লেখা থাকা দেখতে পাবেন যে কর্টেক্স এ৫৩ অথবা এ৫৭। এবং খেয়াল করুন যতো বেশি নম্বর দেওয়া থাকবে ততো ভালো আর্কিটেকচার ডিজাইন হবে। এর পর চেক করে দেখুন প্রসেসরটি যে টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে সেটা কোন টেকনোলজির। সেটা ১৪ ন্যানোমিটার না ১৬ না ২০? এই সাইজ যতো কম হবে আপনার প্রসেসর ততো বেশি গতি সম্পূর্ণ হবে এবং পাওয়ার কম খরচ করবে। তৃতীয়ত খেয়াল করে দেখুন প্রসেসরটিতে নাম্বার অফ কোর কতটি আছে। কোর যতো বেশি হবে ততো ভালো কথা, কিন্তু এর সাথেসাথে টেকনোলজি এবং আর্কিটেকচারও উন্নত হওয়া প্রয়োজনীয়। মনে করুন একটি প্রসেসর তৈরি করা হয়েছে ২৮ ন্যানোমিটার টেকনোলজিতে এবং সেটিতে ২৫ কোর আছে এবং আরেকটি প্রসেসর তৈরি করা হয়েছে ১০ ন্যানোমিটার টেকনোলজিতে এবং সেটিতে ৮ কোর আছে তবে ৮ কোর ওয়ালা প্রসেসর ২৫ কোরকে পিছে ফেলে আগে চলে যাবে।
চতুর্থ বিষয়টি হলো ফ্রিকুএন্সি, যা আপনি সচরাচর গিগাহার্জ এর রূপে দেখতে পান। এটিও যতো বেশি হবে ততো বেশি ভালো। কিন্তু পিছনের আলোচ্য তিনটি জিনিস সমান উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
শেষ কথা
আশা করছি মোবাইল প্রসেসর নিয়ে আপনার মনে থাকা সকল দ্বিধা দন্দ এবং ভুল ধারণা গুলো দূর হয়ে গেছে। এবং এবার থেকে আপনি যখনই কোন নতুন ফোন কিনতে যাবেন তখনই আজকের বর্ণিত ৪ টি বিষয়ের উপর বিশেষ খেয়াল রাখবেন। শুধু নতুন ফোন কেনার ক্ষেত্রেই না বরং যখনই দুইটি বা তিনটি মোবাইল প্রসেসর একে অপরের সাথে তুলনা করবেন তখনই এর পেছনের ইতিহাস গুলো ভালোভাবে দেখে নিয়ে তবেই ভালো মন্দ রায় তৈরি করবেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট টি আপনার বন্ধুর সাথে শেয়ার করতে একদম ভুলবেন না। তাছাড়া এই বিষয়ে আপনার যেকোনো প্রশ্ন আমাকে কমেন্টে জানাতে একদম ভুলবেন না। এবং আপনি যদি কম্পিউটার প্রসেসর বৃত্তান্ত জানতে চান তবে আমার আর্টিকেলটি পড়ে নিতে পারেন।