আর্টিকেল

মানবিক মূল্যবোধ কি | মানবিক মূল্যবোধ বলতে কি বুঝায়

মানবিক মূল্যবোধ পরিমাপ করব কিভাবে ?

মান আর হুঁশ- এই দুইয়ের  মেলবন্ধনই আমাদের মানুষ করে তোলে। কেবল মানুষের মত অবয়ব, শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকলেই কেউ মানুষ হয়ে যায় না। ধীরে ধীরে আমাদের মানুষ হয়ে উঠতে হয়। এই ক্রমোন্নতির পথ রচনা করে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ।

আমাদের অন্তরের চেতনা, মানবিক মূল্যবোধই তো আমাদের অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করেছে। শুধু নিম্নশ্রেণীর জীবদের মত আহার, নিদ্রা, মৈথুন বা অন্যান্য জৈবিক কাজ নয় আমাদের এই মূল্যবোধই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

রামকৃষ্ণদেব বলতেন জন্মেছিস যখন দাগ রেখে যা। এই দাগ মানে হল সমাজের জন্য কিছু করা। আরও উন্নততর চিন্তাভাবনার সৃষ্টি করা। আর সেটা সম্ভব আমাদের মানবিক মূল্যবোধ গুলির উন্মেষ ঘটিয়ে।

কি করে আমাদের সমাজকে আরও সুন্দর, সুশৃঙ্খল বানানো যায় সেই চর্চা বহুযুগ ধরে জ্ঞানী মানুষ, দার্শনিকরা করে আসছেন। আর একটা সমাজ তখনই সুন্দর, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় যখন সেই সমাজের মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধগুলি প্রকট থাকে।

Post Contents

মানবিক মূল্যবোধ কি । মানবিক মূল্যবোধ বলতে কি বুঝায়

মানবিক মূল্যবোধ হল বিশেষ কতগুলি গুণ যা আমাদের চারিত্রিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে। যখন থেকে আমাদের চেতনার উন্মেষ ঘটে, আমরা নিজেদের ভাবনা, বিচার বুদ্ধি দিয়ে কোনোকিছুকে গ্রহণ করতে শিখি আমাদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়।

এই মূল্যবোধ গুলি আমাদের জীবনের ছত্রে ছত্রে, আচার আচরণে ফুটে ওঠে।

মানব জীবনের কিছু গুণ যেমন স্নেহ, ভালোবাসা, মমত্ব, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্বশীলতা, ক্ষমা করার ক্ষমতা, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার, ইত্যাদির সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ হল মানবিক মূল্যবোধ। এটি মানব জীবনের অর্জিত বৈশিষ্ট্য। সাধারণত পুঁথিগত বিদ্যা বা ফর্মুলার দ্বারা রপ্ত করা যায় না।

কথায় বলে আমাদের জীবন হল আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। জীবন পথে চলতে গিয়ে নানা ঘটনা, আমাদের পারিপার্শ্বিক জগৎ, বেড়ে ওঠার পরিবেশ এই সব থেকেই মানুষ তার মানবিক মূল্যবোধের রসদ সংগ্রহ করে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও বুঝতে সুবিধা হবে।

ধরে নেওয়া যাক একটি দম্পতি যমজ সন্তানের জন্ম দিলেন। দুজন সন্তানের মধ্যে একজনকে একটি সুন্দর, সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে দেওয়া হল এবং অপরজনকে একটি অপরাধপ্রবণ এলাকায় অপরাধীদের সঙ্গে বড় করে তোলা হল।

এক্ষেত্রে দুজন শিশু একই মায়ের সন্তান হলেও পরিবেশের তারতম্যের জন্য তাদের ভিন্ন ভিন্ন মানবিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে।

মানবিক মূল্যবোধ পরিমাপ করব কিভাবে ?

মানবিক মূল্যবোধ তো আসলে মনের সুকুমার, কোমল বৃত্তিগুলির বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ।

এটা তো কোনও বস্তু নয় যে কার মানবিক মূল্যবোধ কতটা সেটা পরিমাপ করা যাবে! তাহলে কি আদেও পরিমাপ করা সম্ভব এই মূল্যবোধ? সম্ভব।

একটি মানুষের থেকে অপর মানুষকে তার আচার আচরণ দিয়েই তফাৎ করা যায়। কোনও মানুষ একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে, পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করছে সেটাই মানবিক মূল্যবোধের মাপকাঠি ধরা যায়।

উদাহরণস্বরূপ, বলা যায় কোনও মানুষ তাঁর অধঃস্তন কর্মচারীর সঙ্গে কি ভাবে আচরণ করছেন, কতটা সংবেদনশীলতার সঙ্গে তাঁর সামনে নিজেকে তুলে ধরছেন সেটাই তাঁর মূল্যবোধের মাপকাঠি। ধরা যাক কোনও ব্যক্তি একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেন।

সেখানে তিনি কর্মরত ওয়েটারকে কি ভাষায় সম্বোধন করেন, মানুষ হিসেবে সেই ওয়েটারের প্রাপ্য সম্মানটুকু তিনি দেন কি না সেটাই বিবেচ্য।

কিংবা কেউ তাঁর বাড়ির রাঁধুনী, গাড়ির চালক বা কাজের দিদিকে যদি পরিবারের অংশ না ভেবে চাকর বাকরের মত ভাবেন তাহলে অবশ্যই তাঁর মানবিক মূল্যবোধ কম।

মানবিক মূল্যবোধের উপাদান গুলি কি কি ?

সাধারণত সকল মানবিক গুণগুলির সংমিশ্রণই হল মানবিক মূল্যবোধ।

আসুন দেখে নেওয়া যাক কি সেই উপাদানগুলি।

১. স্নেহ:

মানবিক মূল্যবোধের একটি পরিমাপক হল স্নেহ। প্রত্যেক মানুষ তাঁর পরিবার, সন্তানের প্রতি স্নেহশীল থাকে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু শুধু পরিবার বা নিজের সন্তানের বাইরের মানুষকে স্নেহ করতে পারার ক্ষমতা অবশ্যই মানবিক মূল্যবোধের পরিচয়।

কেউ যদি স্নেহশীল হন, তবে জগৎসংসারে সবকিছুই তিনি স্নেহের চোখে দেখবেন। তা সে ফুটপাতে শুয়ে থাকা কোনও শিশু হোক বা কোনও অবলা পশু।

২. সত্যবাদী:

দুনিয়ায় যা সত্য সেটাই সুন্দর। মানব জীবনের অন্যতম একটি বড় গুণ হল যে কোনও পরিস্থিতিতে সত্যি বলতে পারা , সত্যকে উদার চিত্তে গ্রহণ করা। সত্যের জন্য সব কিছুকে বর্জন করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে বর্জন করা যায় না।

যুগে যুগে দার্শনিক এবং মনীষীরা আমাদের সত্যের পথে চলার কথাই বলে। দুনিয়ার সমস্ত ধর্মমত, ধর্মগ্রন্থ আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

৩. ভালোবাসা:

ভালোবাসা হল ঈশ্বর। আমরা জানি জীবে প্রেম, মানব সেবাই হল ঈশ্বরের সেবা।  মানব জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যবোধ হল ভালোবাসা। ভালোবাসা বহুমুখী। যে কোনও সম্পর্ক, যে কোনও রূপে তা থাকতে পারে।

সন্তানের প্রতি মা, বাবার ভালোবাসা, মা বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা কিংবা প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে ভালোবাসা। নিজের দেশ তথা মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা, পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা বা ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ- সবই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

৪. অহিংসা:

অহিংসা পরম ধর্ম। গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী অহিংসার পাঠ দিয়েছেন আমাদের। বর্তমানে সমাজে যে বিশৃঙ্খলা, অচলাবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি তার অন্যতম কারণ হল মানুষে মানুষে হিংসা। তা সে দুই দেশের মধ্যে হোক কিংবা দুজন মানুষ।

হিংসার বশবর্তী হয়ে আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ, রক্তস্নাত পৃথিবী, এত মানুষের মৃত্য এসবের মূল আধার কিন্তু হিংসাই। সমাজে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব যদি আমরা হিংসার পথ বর্জন করে অহিংসার পথ অবলম্বন করি।

অহিংসা হল মানবিক মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। মূলত তিনভাবে একে আমরা দেখতে পারি।

  • ব্যক্তিগত স্তরে: ব্যক্তিগত স্তরে অহিংসার অর্থ হল অপর মানুষের উন্নতিতে ঈর্ষা না করা, মানুষের ভালো চাওয়া, অপরের ক্ষতিসাধন না করা।
  • সামাজিক স্তরে: সামাজিক ক্ষেত্রে অহিংসার অর্থ সমাজের সকল মানুষকে মূল্য দেওয়া। অসৎ সঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে, সমাজের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
  • সার্বজনীন স্তরে: অহিংসা নৈতিকতা, সমতা এবং সমস্ত মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে;  এটি সমস্ত সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রশংসার পাশাপাশি পরিবেশগত উদ্বেগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করে।  এটি সার্বজনীন ভালবাসার একটি অভিব্যক্তি যা মানুষের মধ্যে ঐক্য জাগিয়ে তোলে।

৫. ক্ষমা করার গুণ:

প্রভু যীশুকে অত্যাচার, নিপীড়ন করে ক্রুশবিদ্ধ করা হল তখনও তিনি পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে অপরাধীদের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এদের ক্ষমা করো, এরা কি করছে এরা জানে না।

অর্থাৎ ক্ষমা করতে পারা হল মানবিক মূল্যবোধের অন্যতম একটি উপাদান। মানবতার পূজারী গৌতম বুদ্ধ বলতেন, অপরাধী তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না হলেও তাকে ক্ষমা করা উচিত। কারণ ক্ষমা করতে পারলে আসে মানসিক শান্তি।

মানবিক মূল্যবোধের উপকারিতা কি ?

মূল্যবোধ বর্জিত মানুষ পশুর সামিল। যদি আমাদের মধ্যে মূল্যবোধ না থাকে তবে আমাদের চেতনা জাগ্রত হবে না। একটি উন্নততর সমাজ গঠনে মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। যথা –

  • মানবিক মূল্যবোধ আমাদের সংবেদনশীল, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল ও দয়ালু বানায়।
  • মানবিক মূল্যবোধ আমাদের অপর মানুষকে সম্মান করতে, শ্রদ্ধা করতে শেখায়। যদি আমরা অন্যের অনুভূতি, ভাবাবেগকে সম্মান দিতে শুরু করি তবে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারব আমরা।
  • মূল্যবোধ একটি সুসংহত, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
  • মানুষের মধ্যে দায়বদ্ধতা, নৈতিক কর্তব্য, ঠিক ভুল বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে।
  • একটি শিশু যখন মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষাগুলি পেয়ে বড় হয় সেই শিশু রাষ্ট্রের জন্য, সমাজের জন্য, নিজের পারিপার্শ্বিক ও পরিবেশের কাছে সম্পদ হয়ে ওঠে। যা বর্তমানে ক্রম ক্ষয়িষ্ণু সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • মূল্যবোধ মানুষকে সুশৃঙ্খল করে তোলে।
  • হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা বর্জন করে সকলকে আপন করে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।

আজকের সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে দাঁড়িয়ে মানবিক মূল্যবোধের অভাবটা সর্বত্র খুব স্পষ্ট।

খবরের কাগজের পাতা হোক কিংবা সারাদিন গণমাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যায় সমাজ জুড়ে শুধু হিংসা, হানাহানি, রক্তক্ষরণ।

আমরা শুধু আমাদেরকে বাড়ির উঠোন থেকে ফ্ল্যাট বাড়ির স্কোয়ার ফিটে কুক্ষিগতই করে নিইনি, জয়েন্ট ফ্যামিলি থেকে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সুখ খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি জীবনের কিছু মানবিক মূল্যবোধ।

সকলের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে করতে শুধুই একটা যন্ত্রে পরিণত হচ্ছি। যার মূল্য চোকাতে হতে পারে আমাদের ভাবী প্রজন্মকে।

তাই সমাজকে সুন্দর করে গড়ে তোলার দায়িত্ব টা আমাদেরই নিতে হবে।

এই বিশ্বকে এই শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার কর্তব্যটা রয়েছে আমাদেরই কাঁধে। খুব বেশি দেরি হয়নি এখনও। আসুন সকলে মিলে হাতে হাত রেখে মানবিক মূল্যবোধের ভিতটাকে মজবুত করি, সুন্দর সমাজ গড়ি।

আমাদের শেষ কথা,,

তাহলে আশা করছি, মানবিক মূল্যবোধ কাকে বলে বিষয়টা নিয়ে সম্পূর্ণটা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছেন। আশা করছি আমাদের আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা অবশই নতুন কিছু জানতে পেরেছেন। আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে নিচে কমেন্ট করে অবশই জানাবেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button