অলসতা এটা মানুষের মজ্জায় মজ্জায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কেউ যদি কাউকে ডায়রেক্ট বলে, তুই এত অলস কেন? তাহলেই হয়েছে। পুরো ফোঁস করে উঠে সে তার কৈফিয়ত দেবে যে, সে অলস নয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সে জানে সে কত খানি অলস।
এই একটা গুণ যা আমরা কেউ নিজেদের থাকলেও স্বীকার করিনা।
আর অলসতা হল সেই জিনিস যা মানুষকে আসতে আসতে নীচে থেকে নীচে নামিয়ে দেয়।
কোনো কাজ পড়ে থাকলে কাল করব বলে ফেলে রাখা, আলসেমি ভাব, যাকে এককথায় বলা যায় শ্রমবিমুখ, কুঁড়ে, অকর্মণ্য, উদাস, মন্থর প্রকৃতির, অন্যমনস্ক ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর এই অলসতা জীবন থেকে দূর না করলে প্রাত্যহিক জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
খেতে, বসতে, উঠতে, কাজ করতে একবার অলসতা এসে গেলে, তার আর মন বেঁধে উদ্যমী হয়ে কাজ করা প্রায় হয়ে ওঠে না।
শুধু বসের কথা শোনাই নয়, জীবন যাপনেও আসে সমস্যা। সাথে নানাবিধ রোগ ব্যাধিও পিছু ছাড়েনা তার।
অলসতা দূর করার উপায় | কিভাবে অলসতা দূর করা যায়
আসুন জেনে নিই, অলসতা দূর করার সেরা দশটি উপায় গুলো কি কি।
১) বড় বড় কাজকে, ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করুন :
বড় কোনো কাজকে একটানা করে গেলে তা যেমন আপনার মানসিক শান্তির বিঘ্ন ঘটায়, তেমনি আপনার শরীর কেও করে দেয় দুর্বল। এনার্জি লস হয় প্রচুর। তার চেয়ে বরং কাজ গুলিকে কিছু ছোটো ছোটো পার্টে বিভক্ত করে নিন।
সময়মতো এক একটি কাজকে গুছিয়ে করে ফেলুন। দেখবেন বড়ো কাজটিতে আপনি বাজিমাত করেছেন।
ধরুন আপনার বস আপনায় সোমবারের প্রেজেন্টেশনে দুইঘন্টা টানা বলতে বলেছেন। আপনি হতাশ। এতটা সাজাবেন কি করে! তার চেয়ে বরং কাজটিকে পার্টে ভাগ করে নিন।
ব্যাস কাজও সুন্দর, সময়েও মিটবে, আপনার অলসতা আসবে না।
অনেক সময় বেশি চাপের কাজেও এসে যেতে পারে অলসতা।
পারছিনা বা হাল ছেড়ে দেওয়া মনোভাব এই অলসতার প্রধান অস্ত্র হয়ে আপনার ব্যক্তিত্ব ও কাজ করার অনুভূতি সব তিলে তিলে শেষ করে দেয়।
২) টাইম ম্যানেজমেন্ট :
সময়কে যারা গুরুত্ব দেন তাদের অলসতা কখনোই ঘিরে ধরে না।
কারণ তারা টাইম ম্যানেজমেন্ট করে জানেন কোন সময় কি কাজটা করে সময় বাঁচাবেন।
নিজেকে ফ্রি রাখবেন। এরা সর্বদাই অলসতাকে দূরে রাখেন।
আপনার যেখানে সকাল ন’টায় পৌঁছানোর কথা, আপনি গেলেন আধঘণ্টা দেরিতে।
কথা তো শুনতে হলই, সাথে আপনি যে শ্রমবিমুখ এটা সেখানকার সকলেই অনুধাবন করল।
যদি টাইম সম্পর্কে সিরিয়াস হতেন তাহলে দেরিও হতো না, সাথে আপনার প্রতি কারোর খারাপ ধারণা জন্মাতো না।
৩) পরিকল্পনা করে কাজ করুন :
অলসতাকে দূর করার জন্য পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। সে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
আপনার কোনো কাজে সমস্যা সৃষ্টি হলে কিংবা কাজ করার সময় ঠিক ঠাক না পেলে নিজের সময়কে রুটিন বা তালিকার আন্ডারে ফেলুন।
কাজ গুলি লিপিবদ্ধ করুন। ডাইরি মেইনটেইন করুন। দেখবেন অলসতা তো দূরস্থ কাজ করার এনার্জি আপনাকে করে তুলেছে কমবয়সী।
৪) লক্ষ্য ঠিক রাখুন :
যে সব মানুষের লক্ষ্য ঠিক নেই, তারা সত্যিকারের অলস মানুষ।
কথায় বলে অলস বুদ্ধি শয়তানের বাসা। আর যাদের নিজেদের লক্ষ্য ঠিক নেই তারা না তো নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করে, আর না অন্যের লক্ষ্য ঠিক রাখতে চেষ্টা করে।
আর যখন নিজের লক্ষ্যে আপনি ঠিক থাকেন না তখন ধরে নিতে হবে আপনার মধ্যে অলসতা বাসা বেঁধেছে। আপনি কর্মঠ হয়ে ওঠার পথ থেকে পিছিয়ে হাঁটছেন।
ধরুন আপনার যে কাজটি করার কথা ছিল আপনি সেই কাজটি করার জন্য আরো সময় নিচ্ছেন, বা চাইছেন।
কিন্তু তার থেকেও কম সময়ে আপনি কাজটি করে ফেলতে সক্ষম। অর্থাৎ আপনার মধ্যে বাসা বেঁধেছে অলসতা।
এর ফলে নিজেকে সময় দিন। ভাবুন আপনি কাজটি কেন করবেন। যদি সেই কাজে ভালোবাসা থাকে এবং সেই কাজে সম্মান থাকে, আনন্দ থাকে তাহলে প্রাণবন্ত হৃদয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন সেই কাজে। মনে করুন আপনি ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান।
যদি মনে করেন শীর্ষে তাহলে সময়কে গুরুত্ব দিয়ে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকুন। কখনোই হেরে যাওয়ার ভয়ে পিছিয়ে এলে চলবে না।
৫) সুদূর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করুন এখন থেকেই :
এই কথাটি শুনলে অনেকেই অবাক হবেন। জীবনটা দেখা বাকি, জীবনে কত কি করা বাকি! আর এখন থেকেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু করব, তা কি কখনো হয়! আমি কিভাবে জানবো আমার ভবিষ্যতে কি হবে? হ্যাঁ। তা ঠিক।
আমরা জানিনা, আমাদের ভবিষ্যতে কি হবে। ভবিষ্যৎ কখনো আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমাদের হাতে নেই বলে, আমরা কখনই আমাদের ভবিষ্যৎ কে ছেড়ে দিতে পারি না।
জীবনে ওঠা পড়া অনেক এলেও যে চিন্তা, যে ভাবনা, যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা ভবিষ্যতের দিকে এগোই তা কিছু না কিছু হলেও সম্পূর্ণ হয়। তাই অবশ্যই এখন থেকেই সুদূরপ্রসারী, বাস্তববাদী ভবিষ্যত পরিকল্পনা শুরু করুন।
৬) পজিটিভ থাকার কৌশল আয়ত্ত করতে শিখুন নিজের জীবন থেকেই :
জীবনে অনেক ওঠাপড়া আসবে সেটাই বড় কথা নয়। কিন্তু পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে জীবনে পজিটিভ থাকাটাই হলো বড় কথা।
ধরুন, আপনি কোন কাছের মানুষকে হারিয়েছেন কিংবা ধরুন আপনি আপনার লক্ষ্য বা আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন।
তাই বলে কি, নিজেকে নেগেটিভ করে নিজের জীবন দর্শনকে ভুলে হারিয়ে যাবেন এই পৃথিবীর বুক থেকে! না তা নিশ্চয়ই সমাধানের পথ নয়।
জীবনের সব সময় সফলতা আসবে এটা ভাবাও ঠিক নয়।
সফলতা ও অসফলতা একই দেওয়ালের দুই পিঠ, একটি যেমন আছে তেমনি অপরটিও আছে।
কাজেই, অসফলতা এল বা সফলতা এলোনা এই মনে করে নিজেকে কখনোই হেয় বা ছোট করা উচিত নয়।
জীবনে পজিটিভ থাকার কৌশল আয়ত্ত করতে শিখতে হবে নিজের জীবন থেকেই।
আর মনে রাখতে হবে অসফলতা এসেছে মানে এর পরে সফলতা আসতেও পারে এবং আসবেই, নিজেকে নিজের কাছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলুন।
আর নিজের জীবনে পজেটিভ থাকলে বা নিজের জীবনে নিজেকে পজেটিভ থাকার কৌশল আয়ত্ত করতে শিখে গেলে, আপনি হয়ে উঠবেন একজন অলসহীন ব্যক্তি।
৭) সব সময় রিল্যাক্স থাকুন :
কোনকিছুকেই অতি গুরুত্ব সহকারে, এবং ভয় হিসাবে নেবেন না। জীবনে সব সময় রিল্যাক্স থাকার চেষ্টা করুন।
আপনি যদি সব সময় টেনশনে এবং চিন্তায় থাকেন তাহলে কোন কাজই গুরুত্বসহকারে করতে পারবেন না।
এবং গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে না পারলে সেই কাজ কখনো সফলতা হিসাবে ধরা দেবে না আপনার কাছে।
বাধ্যতই, সেই কাজের শ্রম যাবে বৃথা।
আপনি কাজ করবেন, টেনশন করে – চিন্তা করে কাজ করবেন, অথচ সেই কাজ আপনার মনের মত হবে না, সেই কাজ করে আপনিও সুখী হবেন না, যে কাজে আপনি আপনার একশ শতাংশ দিতে পারবেন না, সেই রকম কাজ করার কোন দরকার নেই।
যে কাজে আপনি স্যাটিস্ফায়েড নন সে কাজ আপনি কখনো করবেন না। সব সময় রিল্যাক্স থাকুন।
আর টেনশন ফ্রি থাকলে সেই কাজ হয়ে উঠবে আপনার মনের মত।
অলসতা দূর করতে গেলে রিল্যাক্স থাকা খুবই জরুরী জীবনে।
অন্যথায়, অলসতার চোটে যখন আপনার চিন্তা ও টেনশন বৃদ্ধি পাবে কিংবা চিন্তা ও টেনশনের জন্য যখন অলসতা বৃদ্ধি পাবে তখন কিন্তু তা মাইগ্রেন বা মাথার যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠবে। শরীর খারাপ হতে বাধ্য করবে।
কাজেই নিজের জীবন থেকে অলসতা দূর করুন। চিন্তা ও টেনশন কমান। সুস্থ থাকুন।
যেকোনো কাজ ভালোবেসে করুন। আর অলসতাকে দূর করতে জীবনে রিল্যাক্স থাকার চেষ্টা করুন।
রিল্যাক্স থাকার জন্য নতুন নতুন অভ্যাস গড়ে তুলুন নিজের জীবনে।
৮) নিজেকে ভালোবেসে নিজের জন্য ভাবুন, একান্তে সময় দিন :
আপনি এখনো পর্যন্ত জীবনে কতটা কি করতে পারলেন, কি কি পারলেন না, কেন পারলেন না, আপনার ভবিষ্যতের লক্ষ্য কি, কি ভাবে সেগুলোতে সাফল্য পেতে পারে, কি কি কারণে আপনার কোন্ কোন্ কাজ আটকে আছে, কেন আছে – এই সবগুলি নিয়ে সারাটাদিনে কিছুটা সময় বের করে একান্তে ভাবুন কিছুক্ষণ।
নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের জন্য ভাবুন।
এই সব ভাবনাচিন্তা গুলোর মধ্য দিয়ে আপনি খুঁজে পাবেন আপনার কেন অলসতা আসছে।
আপনি কেন কাজ করতে পারছেন না, বা কেন কাজ করতে চাইছেন না। সেটা কি মানসিক কোনো কারণ নাকি শারীরিক কারণ।
যে কাজগুলো আপনি করতে পারছেন না সেগুলি ঠিকমতো করার জন্য কি কি করতে হবে আপনাকে, তা নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসবে আপনার কাছে এই ভাবার মধ্য দিয়ে।
খামোখা কোনো চিন্তা নয় এবং এমন চিন্তা করবেন না যাতে আপনি রিল্যাক্স না থাকতে পারেন।
সুতরাং অলসতা দূর করতে নিজেকে কিছু ভাবা ও কিছু কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখাও জরুরি।
৯) অন্যের কথায় কখনও কান দেবেন না :
আপনি অন্যের কথায় যখন বেশি কান দেবেন তখন অন্যের কথা ও অন্যকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা, যেটা আপনার মাথার মধ্যে সর্বদা ঘুরপাক খাবে, এটা কখনই উচিত নয়।
তাই সর্বদা অন্যের কথায় কান দেবেন না ও অন্যের কথায় বেশি গুরুত্ব দেবেন না।
অলসতা জীবন থেকে দূর করতে চাইলে অন্যকে আপনার জীবনে বেশি প্রাধান্যতা দেবেন না।
১০) সারা দিনের অধিকাংশ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করবেন না :
সারা দিনের অধিকাংশ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করার মত অলসতা আর কিছু হতে পারে না। চেষ্টা করা উচিত সারা দিনের বেশিরভাগ সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে রেখে, নিজেকে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখা।
সামান্য কিছু চিন্তা-ভাবনা করা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা এবং নিজের লক্ষ্য স্থির রাখা। আপনার জন্য যাভএকান্ত বাঞ্ছনীয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিং কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাজট্যাগ দিয়ে পোস্ট, ঘন ঘন ছবি বা ভিডিও আপলোড, এতো বড় বড় জ্ঞানমূলক কথা বার্তা লেখা কিংবা টিকটক ভিডিও করা অথবা ইনস্টাগ্রামে এটা ওটা আপলোড ইত্যাদিতে আপনার সময় যেমন নষ্ট হয় ঠিক তেমনি চোখের ক্ষতি তো হয়ই, তেমনি আপনার অলসতাকে ডেকে আনে ঘরে।
ফেসবুক খুলতে খুলতে পাতার পর পাতা স্ক্রল করে যাওয়া, কিংবা ইনস্টাগ্রামে এর ওর স্টোরি দেখা, এই করে যে আপনার কত সময় নষ্ট হয় তার ইয়ত্তা নেই।
এর থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। নয়তো আপনার অলসতা দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকবে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনকার দিনের অলসতা যদি বেড়ে গিয়ে থাকে তো তার প্রধান অন্যতম কারণ হলো সারা দিনের অধিকাংশ সময় নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত রাখা। এর থেকে নিজে ও নিজের পরিবারকে সময় দেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মেডিটেশন ও মোটিভেশনাল জিনিস আপনার জন্য খুবই কার্যকর।
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে শতহস্ত দূরে রেখে, টিভি ও অন্যান্য জিনিসপত্রে নিজেকে ব্যস্ত না রেখে যদি নিজের সন্তান, নিজের পরিবারকে সময় দিতে পারেন তাহলে আপনার মতন ব্যক্তি আর কেউ হবে না।
কাজেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করলে একটু ভেবেচিন্তে করবেন ও তাতে কম সময় দেবেন
আমাদের শেষ কথা,,
তাহলে বন্ধুরা, অলসতা দূর করার উপায় গুলো এখানে বলা হলো। আপনি যদি ঠিক মত এই উপায়গুলি নিয়মিত মেনে চলেন আপনাকে সবাই কর্মঠ, পরিশ্রমী ও অলসহীন মানুষ বলে ভাববে। সবাই চেষ্টা করবে আপনাকে আদর্শ হিসাবে মেনে চলতে।
ওপরে বলা এই প্রত্যেকটি অলসতা কাটিয়ে সফল হওয়ার উপায় গুলো যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশই আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে, নিচে কমেন্ট করে অবশই জানাবেন।