লাই ডিটেক্টর | পলিগ্রাফ | সত্যিই কি সত্য/মিথ্যা যাচাই করতে পারে?
পলিগ্রাফ কি সত্যিই মিথ্যা যাচাই করতে পারে?
আমরা মানুষেরা একটু বেশিই বুদ্ধিমান, আর এই বুদ্ধিমত্তারই আরেকটি ফিচার হলো মিথ্যা বলা বা সত্যকে লুকানো। মানুষেরা অনেক কারণে মিথ্যা বলে থাকে; নিজের জান বাঁচাতে, শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে, জেল থেকে রক্ষা পেতে ইত্যাদি। কিন্তু ন্যায় বিচার কায়েম করার জন্য মিথ্যাকে চিহ্নিত করে সত্যকে খুঁড়ে বেড় করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু ঠিক কিভাবে সঠিকভাবে সত্য/মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব? প্রশিক্ষিত আইন অফিসারেরা বিভিন্ন প্রশ্ন করে কোন মিথ্যাবাদীকে বিভ্রান্ত করে দেয় এবং বুঝতে পারে সে মিথ্যা বলছে কিনা। তবে উপযুক্ত প্রমান এবং সাক্ষী ছাড়া কারো মিথ্যা পরিপূর্ণভাবে প্রমানিত করা সম্ভব নয়। ক্রিমিন্যাল বিভাগের বিজ্ঞানীরা অনেক বছর যাবত এমন কিছু আবিষ্কার করার চেস্টায় ছিলেন, যা সত্য, মিথ্যাকে যাচায় করার ক্ষমতা রাখে। আর পলিগ্রাফ (Polygraph) বা লাই ডিটেক্টর (Lie Detector) মেশিন আবিস্কারের পরে তারা তাদের আবিস্কারের অনেক কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। ওয়েট… এক মিনিট ভাই… “লাই ডিটেক্টর? মানে যেটা হলিউড, বলিউড মুভিতে এতদিন দেখেছি?, কেন যে এগুলো পোস্ট লেখার চেষ্টা করেন? আরে ব্যস্তবে নেই এসব!!!” হ্যাঁ ভাই এটি সত্যিই রয়েছে, এটি মানুষের বিভিন্ন সেন্সরের তথ্য গুলোকে গ্রাফ আঁকারে প্রকাশ করে এবং সাধারনের চেয়ে বেশি উত্তেজিত রেজাল্ট প্রদান করলে আমরা মেনে নেই, ব্যক্তিটি মিথ্যা বলছে। তবে এটি কতটুকু নিশ্চয়তার সাথে কাজ করে এটিই আজকের মূল প্রশ্ন।
পলিগ্রাফ কি?
লাই ডিটেক্টর বা পলিগ্রাফ মেশিনের কথা নিশ্চয় শুনেছেন, অনেকে হয়তো এটি মুভিতে হাঁসি ঠাট্টা হিসেবে ভেবেছিলেন এতোদিন, কিন্তু এখন জানলেন এটি সত্যি রয়েছে। যখন কোন ব্যক্তির এই মেশিনে বসিয়ে টেস্ট নেওয়া হয়—সাধারনত তার ৪-৬টি সেন্সরের সাথে এটিকে আটকিয়ে রাখা হয়। পলিগ্রাফ শব্দের মধ্যে “পলি” মানে হচ্ছে একসাথে একাধিক সেন্সরের রিপোর্ট এবং “গ্রাফ” শব্দের মানে হচ্ছে একটি পেপার গ্রাফে সেন্সর থেকে আসা সিগন্যাল গুলোকে অঙ্কিত করা হয়। এই মেশিনটি মূলত মানুষের নিশ্বাস নেওয়ার ধরণ, হার্ট বিট, রক্তচাপ, ঘাম ইত্যাদি সহ অনেক সময় হাত পায়ের নড়াচড়া করার ধরণও মনিটর করে থাকে।
মানুষেরদেহ এবং এর বিভিন্ন সেন্সর কিভাবে কাজ করছে এর সাইড বাই সাইড গ্রাফ তৈরি করে এবং পেপারে অঙ্কিত করে—তবে বর্তমান আধুনিক মেশিনে এই গ্রাফ পেপারের বদলে কম্পিউটার স্ক্রীনে দেখতে পাওয়া যায়। তো এই গ্রাফের উপর কিভাবে কোন ব্যাক্তির সত্য কিংবা মিথ্যা যাচায় করা সম্ভব হয়? যারা পলিগ্রাফ টেস্ট করেন তারা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন এই সেন্সর গুলোর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে এবং এগুলোকে মানুষ দ্রুত নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। আর এই আকস্মিক পরিবর্তন টেস্টারদের প্রমানিত করতে সাহায্য করে—ব্যক্তিটি সত্য বলছে না মিথ্যা।
পলিগ্রাফ টেস্ট, আপনি প্রস্তুত তো?
যে ব্যক্তির লাই ডিটেক্টর টেস্ট নেওয়া হবে তাকে সাধারনত একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয় এবং তার শরীরের সাথে বিভিন্ন সেন্সর লাগিয়ে দেওয়া হয়। আসল প্রশ্ন উত্তর পর্ব শুরু করার আগে সাবজেক্টকে (যার টেস্ট নেওয়া হচ্ছে) রিলাক্স করানোর জন্য সাধারন প্রশ্ন করা হয়। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে পরীক্ষক সাবজেক্টকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে, যেমন— “তোমার নাম কি” এক্ষেত্রে সে সত্য কথা বলবে, “তুমি কি খেলতে পছন্দ করো?” “তুমি কখনো কিছু চুরি করেছো?” “তুমি কখনো টাকা চুরি করেছো?” ইত্যাদি প্রশ্ন করে সাবজেক্টকে মিথ্যা বলাতে জোর দেওয়া হবে। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাওয়ার পরে পরীক্ষক গ্রাফের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য করে সত্য উত্তর এবং মিথ্যা উত্তর গুলোকে বুঝে চিহ্নিত করে রাখবে।
এবার পরীক্ষক সাবজেক্টকে আসল ক্রাইমের উপর প্রশ্ন করতে আরম্ভ করবে যা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। পরিশেষে আগের গ্রাফের সাথে বর্তমান টেস্ট করা গ্রাফের মিল করানো হবে। তাত্ত্বিকভাবে, সত্য এবং মিথ্যার গ্রাফ সম্পূর্ণ ভিন্ন রেখা প্রদান করে।
পলিগ্রাফ = লাই ডিটেক্টর?
অনেকে মনে করেন পলিগ্রাফ মেশিনই হলো “লাই ডিটেক্টর”—আসলে এটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়। পলিগ্রাফ সাধারনত একটি মেশিন যা শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে সাইড বাই সাইড গ্রাফ তৈরি করে। এবং এই মেশিনটি নিজে থেকে কোন সত্য বা মিথ্যাকে ডিটেক্ট করার ক্ষমতা রাখে না। যে পরীক্ষক এই মেশিনটি পরিচালনা করে সে এটি বিশ্বাস করে যে মানুষের বিভিন্ন সেন্সর থেকে পাওয়া এবং পরিবর্তিত তথ্য থেকে সত্য মিথ্যা যাচায় করা সম্ভব। কিন্তু আগের পলিগ্রাফ মেশিন গুলো কখনোই সত্য মিথ্যা ডিটেক্ট করতো না। তবে এখনকার মডার্ন পলিগ্রাফ মেশিন গুলোর কথা একটু আলাদা, এগুলো সম্পূর্ণ কম্পিউটার চালিত হয়ে থাকে এবং কোন পেপারে গ্রাফ তৈরি করার জায়গায় এতে স্ক্রীনে গ্রাফ তথ্য দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সেন্সর থেকে আসা তথ্য থেকে এর মধ্যে ইন্সটল থাকা সফটওয়্যার পরীক্ষককে সাজেশন দিতে পারে—ব্যক্তিটি সত্য বলছে কিনা মিথ্যা, এখনকার মডার্ন পলিগ্রাফ অনেকটা লাই ডিটেক্টর হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কারো মিথ্যা যাচাই করা এতোটাও সহজ ব্যাপার না।
পলিগ্রাফ কি সত্যিই মিথ্যা যাচাই করতে পারে?
১৯২০ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই পলিগ্রাফ বেশ বিতর্কিত ছিল, যে সত্যিই এটি ঠিকঠাক কাজ করে কিনা। অনেক প্রশিক্ষিত পরিচালকেরা মনে করেন তারা ঠিকঠাক রেজাল্ট বেড় করতে সক্ষম আবার অনেকে এর কাজ করা নিয়ে নিশ্চিত নন। অনেকে মনে করেন পলিগ্রাফের নিশ্চয়তা মানে অনেকটা আকাশে পয়সা ছুড়ে মারার মতো বা তুক্কাবাজী করে কাজ চালানোর মতো। শুধু মানুষের সেন্সর গুলোর পরিবর্তিত রেটের উপর ভিত্তি করে কখনোই সত্য মিথ্যা যাচাই করা উপযুক্ত হবে না। অনেকে দাবি করে, তারা পলিগ্রাফকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নিজেদের শরীরকে প্রশিক্ষিত করতে পারে। ডিসকভারি চ্যানেলে পলিগ্রাফকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল দেখিয়ে এবং প্রমানিত করে একটি শোও সম্প্রচারিত করা হয়েছিলো। তাছাড়া এই অনেক ওয়েবসাইটে পলিগ্রাফকে ধোঁকা দেবার অনেক কৌশল বর্ণিত আছে, জাস্ট “How To Cheat a Polygraph Test” লিখে গুগল করুন, উত্তর নিজেই পেয়ে যাবেন।
তো এটি কতটা কাজের? এই প্রশ্নের উত্তরকে পরিষ্কার করার জন্য আপনাকে জানিয়ে রাখি পলিগ্রাফ অনেক দেশে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং অনেক দেশে একে নিসিদ্ধও করে দেওয়া হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানার জন্য “Employee Polygraph Protection Act of 1988” পড়ে নিতে পারেন।
শেষ কথা
মেশিন কি সত্যিই মানুষের মতো একটি জটিল প্রাণীর সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারবে? আপনার এই ব্যাপারে কি মনে হয়, আমাদের তা কমেন্ট সেকশনে জানান। আপনি কি কখনো পলিগ্রাফ টেস্ট দিয়েছেন? দিয়ে থাকলে তার অভিজ্ঞতার কথা আমাদের সাথে শেয়ার করুন। পোস্টটি ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করুন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।