রিমোট কন্ট্রোল | কীভাবে কোন যন্ত্রপাতিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে?
রিমোট কন্ট্রোল কীভাবে কাজ করে?
আলিবাবা আর তার ৪০ চোরের গল্প মনে আছে, যেখানে আলিবাবা তার আস্থানার দরজার সামনে গিয়ে “খুল যা সিম সিম” বল্লেই দরজা খুলে যেতো? সৌভাগ্যবশত এখন কোন দরজা খুলতে কোন কীওয়ার্ড বলার প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং রয়েছে হাতে এঁটে যাওয়া ছোট সাইজের একটি ডিভাইজ “রিমোট কন্ট্রোল” (Remote Control) যার মাধ্যমে ওয়ার্কশপের দরজা খোলা বা টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করা বা যেকোনো গ্যাজেটকে না ছুঁইয়েই দূর থেকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। সোফায় বসে আর খাটে শুয়ে টিভি দেখায় কখনো এতো মজা পাওয়া যেতো না, যদি এই ছোট্ট ডিভাইজটি চ্যানেল বদলাতে আর ভলিউম আপ ডাউন করতে সাহায্য না করতো। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি এই ডিভাইজটি কীভাবে দূর থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম? আজকের আর্টিকেলে আমরা রিমোটের কাজ করা এবং বিভিন্ন প্রকারের রিমোট সম্পর্কে জানবো। তো অপেক্ষা কীসের?
রিমোট কন্ট্রোল কীভাবে কাজ করে?
রিমোট কন্ট্রোলের সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো এতো কোন তার লাগানো থাকে না। ব্যাস যেটা কন্ট্রোল করার ইচ্ছা সেটার দিকে তাক করে ধরলেই এটি কাজ করতে আরম্ভ করে! অনেকটা ম্যাজিকের মতো। রিমোট প্রধানত বেতার সিগন্যাল ব্যবহার করে কাজ করে, যেটাকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক তরঙ্গ বলা হয়। শুধু আপনার রিমোট নয়, সাথে রেডিও, এক্স-রে মেশিন, মাইক্রোওভেন ইত্যাদি ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক তরঙ্গ ব্যবহার করে কাজ করে। বাতাসের মধ্যদিয়ে এই তরঙ্গ কাঁপতে কাঁপতে সাথে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ম্যাগনেটিক শক্তি আলোর গতিতে বহন করে নিয়ে যায়।
বেশিরভাগ রিমোট কন্ট্রোল, সাথে সম্ভবত আপনারটিও ইনফ্রারেড রেডিয়েশনের উপর কাজ করে। আপনার রিমোটটির উপরদিকে দেখলে একটি এলইডি বাল্ব দেখতে পাবেন, যা থেকে এই ইনফ্রারেড রেডিও তরঙ্গ বেড় হয়। আপনার হাতের রিমোটটি সাধারনত একটি ট্র্যান্সমিটার হয়ে থাকে এবং টিভিতে বা অন্য ডিভাইজে একটি রিসিভার লাগানো থাকে, যেটা রিমোট থেকে আসা ইনফ্রারেড সিগন্যালকে গ্রহন করে কাজ করে। যখন আপনি হাতে থাকা রিমোটটির কোন বাটন প্রেস করেন, রিমোট থেকে একটি ইনফ্রারেড সিগন্যাল বেড় হয়ে বাতাসে আলোর গতিতে ছুটে যায় এবং ডিটেক্টর সেটিকে ডিটেক্ট করে নেয়।
মানুষের চোখ কখনোই ইনফ্রারেড আলোকে দেখতে পায় না, এমনকি চোখের অতি নিকটে এনে রিমোট কন্ট্রোলটি চাপলেও আপনি কিছুই অনুভূত করতে পারবেন না। নাইট ভিশন চশমা নিয়ে আলোচনা করে একটি আর্টিকেলে লিখেছিলাম যে, সব আলোই আসলে দৃশ্যমান হয় না এবং কিছু প্রাণী রয়েছে যাদের ইনফ্রারেড আলো ডিটেক্ট করার ক্ষমতা রয়েছে। র্যাটেল স্নিকের ইনফ্রারেড ডিটেক্ট করার ক্ষমতা রয়েছে—আর এই ক্ষমতার মাধ্যমে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এরা শিকার থেকে আশা ইনফ্রারেড তরঙ্গের মাধ্যমে খাবার খুঁজে পায়। যাই হোক, এই সাপ ইনফ্রারেড ডিটেক্ট করতে পারে বলে, আপনার টিভির রিমোট দিয়ে জেনো একে কন্ট্রোল করার কথা চিন্তা করবেন না। কারণ টিভির রিমোট বা যেকোনো রিমোটের কাজ করার পদ্ধতি একটু আলাদা।
রিমোট কন্ট্রোল কোড
কোন রিমোট যদি লাগাতার শুধু ইনফ্রারেড সিগন্যাল উৎপন্ন করতেই থাকে তবে এতে কোন কাজ হবে না। আপনার টিভির রিমোটে অন্তত ২০টির বেশি বাটন রয়েছে, তাই রিমোট কন্ট্রোলকে অবশ্যই এমন ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে যাতে এই প্রত্যেকটি বাটন প্রেস করাতে আলাদা সিগন্যাল উৎপন্ন করতে পারে এবং টিভি সেটাকে বুঝতে পারে। রিমোট কন্ট্রোলও কম্পিউটারের মতো বাইনারিতে কাজ করে। যখন আপনি রিমোটের কোন বাটন প্রেস করেন তখন এটি হয় অন অথবা অফ সিগন্যাল প্রেরন করে, যেখানে অন মানে ১ এবং অফ মানে ০। রিমোট একত্রে কিছু পালস সেন্ড করে এবং প্রত্যেকটি বাটনে আলাদা পদ্ধতিতে পালস সেন্ড করে। মনেকরুন, আপনি ভলিউম আপ বাটন প্রেস করলেন, তখন এটি অন-অফ-অন-অন-অফ সিগন্যাল সেন্ড করলো, এখন বাইনারিতে একে কনভার্ট করলে দাঁড়ায় ১০১১০। অর্থাৎ টিভিতে থাকা রিমোট রিসিভার যখন ১০১১০ সিগন্যালটি ক্যাচ করবে তখন এটি টিভির ভলিউমকে আপ করে দেবে। ঠিক এভাবেই বিভিন্ন বাটনের জন্য বিভিন্ন সিগন্যাল রিমোট তৈরি করে টিভির কাছে পাঠিয়ে দেয় এবং সেই অনুসারে টিভি কাজ করে।
তবে বিভিন্ন টিভি এবং এর রিমোট আলাদা আলাদা সিগন্যালের উপর কাজ করে। মানে কোন টিভির মডেল ১১০০ মানে ভলিউম আপ করে আবার কোন মডেলদের টিভি ১১০০ মানে চ্যানেল পরিবর্তন করে। এজন্য বিভিন্ন মডেলের টিভির সাথে বিভিন্ন রিমোট কন্ট্রোল দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রিমোট আলাদাভাবে কাজ করার জন্যই আপনার টিভির রিমোট শুধু আপনার টিভিতেই কাজ করে, আপনার রিমোট কন্ট্রোল ফ্যান বা লাইট অন অফ করে দেয় না বা আপনার হোম থিয়েটারের মিউজিক পরিবর্তন করে না। তবে কোন টিভি বা কোন হোম থিয়েটার কোন কোড ব্যবহার করে কাজ করছে এটা যদি আপনি আবিষ্কার করতে পারেন তবে অবশ্যই এমন একটি রিমোট তৈরি করা সম্ভব যেটি সকল যন্ত্রপাতিকে চালাতে সাহায্য করবে। আর এভাবেই কোন ইউনিভার্সাল রিমোট কাজ করে। আজকাল তো ফোনেও ইউনিভার্সাল রিমোট অ্যাপ চালানো যায়। এই অ্যাপে সাধারনত সকল টিভি প্রস্তুতকারী কোম্পানির রিমোট অপারেট কোড থাকে এবং এর সাহায্যে এটি যেকোনো টিভিতে কাজ করে।
রিমোটের প্রকার
এতক্ষণ যে ইনফ্রারেড সিগন্যালে চলা রিমোট নিয়ে আলোচনা করছিলাম সেটি আসলে আইআর রিমোট নামে পরিচিত। আইআর রিমোট অত্যন্ত অল্প পাওয়ারে কাজ করে এবং মুটামুটি ৪০-৭০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত সিগন্যাল পাঠাতে পারে। এর রেডিয়েশন অনেক কম হয় তবে এটি রেডিও তরঙ্গের মতো কোন পুরু দেওয়ালকে ভেদ করার ক্ষমতা রাখে না। তাই আপনার টিভি সেটটি যদি অন্য ঘরে থাকে তবে সেটিকে আলাদা ঘর থেকে আইআর রিমোট ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রন করা অসম্ভব।
আরেক ধরনের রিমোট রয়েছে যাকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রিমোট বা আরএফ রিমোট বলা হয়। রিমোট দরজা, বিভিন্ন খেলনা, হাই কোয়ালিটি হোম থিয়েটার, স্যাটেলাইট রিসিভার ইত্যাদি রেডিও রিমোট প্রযুক্তির উপর কাজ করা রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রন করা হয়। রেডিও রিমোট ব্যবহার করার কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা দুইটিই রয়েছে। অসুবিধা হলো, আপনার সেলফোন, ওয়্যাকি টকি, ওয়াইফাই ইত্যাদি সবই রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করে কাজ করে। আর যেহেতু রেডিও রিমোট ইনফ্রারেড সিগন্যাল না পাঠিয়ে রেডিও সিগন্যাল প্রেরন করে তাই এর সিগন্যাল আলাদা ডিভাইজ থেকে আসা সিগন্যালের সাথে বাঁধাগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে। তবে বর্তমান আধুনিক আরএফ রিমোট সিগন্যাল বাঁধাগ্রস্থ হওয়াকে ঠেকাতে আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে এবং সিগন্যাল কোথাই রিসিভ হবে তার অ্যাড্রেস সাথে সেন্ড করে দেয়। আরএফ রিমোট কন্ট্রোলের সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে এর কাজ করার রেঞ্জ। এটি মুটামুটি ১০০ ফুট দূরত্বে থাকা যন্ত্রপাতিকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
আরো কিছু প্রকারের রিমোট রয়েছে, যেমন ব্লুটুথ রিমোট। সাধারনত পিসিতে ব্লুটুথ রিমোট ব্যবহার করা হয়, ইউএসবিতে একটি রিসিভার লাগানোর প্রয়োজনীয়তা থাকে এবং একটি ট্র্যান্সমিটার দ্বারা পিসিকে কন্ট্রোল করা হয়। তবে একটি ট্র্যাডিশনাল আরএফ রিমোটের তুলনায় ব্লুটুথ প্রযুক্তির উপর নির্ভর রিমোটের রেঞ্জ কম হতে পারে।
তাছাড়া একটি রিমোট কোন কোন ব্যবহার করে কাজ করছে সেটি আরেকটি রিমোটকে শেখানোও যেতে পারে যাতে ঐ রিমোটটি আরেকটি রিমোটের মতো কাজ করতে পারে। একে রিমোট লার্নিং বলা হয়, আপনার রিমোট কন্ট্রোলটিতে যদি লার্নিং ফিচার বিদ্যমান থাকে তবে আপনি যেকোনো রিমোটের ফিচার আপনার রিমোটে প্রদান করতে পারবেন। প্রত্যেকটি লার্নিং রিমোট ইউনিভার্সাল রিমোট হয়ে থাকে—কেনোনা এটি যেকোনো রিমোটের ন্যায় কাজ করার ক্ষমতা রাখে।
শেষ কথা
কয়েকটা বাটন, ইন্ট্যাগ্রেটেড সার্কিট, আর এলইডি বাল্বের সমন্বয়ে গঠিত পকেট সাইজ এই ছোট্ট গ্যাজেটটি আমাদের প্রতিনিয়ত মডার্ন লাইফকে আরো সমৃদ্ধ করছে। আশা করছি এই গ্যাজেটটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরে আপনি অনেক আনন্দিত। আমাকে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করতে নিচে কমেন্ট করতে পারেন এবং আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই লাইক এবং শেয়ার করুন।