আমরা না চাইতেও এমন অনেক বাজে খরচ আছে যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে আমরা অজান্তে বা অনেক সময় জেনে বুঝে করে ফেলি।
এতে মাসের শেষে আমরা যখন টাকার হিসাব করে থাকি তখন দেখা যায়, বেশ অনেক টাকাই আমরা বাজে খরচ করে উড়িয়ে ফেলেছি।
আমাদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি থাকে যারা মাসের বাজেট ছাড়া টাকা খরচ করে থাকে, তাই তাদের অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন জরুরি পেমেন্ট এবং খরচ গুলো বাকি পরে যায় এবং মাসেরটা মাসে ক্লিয়ার করতে না পারায় ধার নিতে হয় এবং সেখান থেকেই একটি নতুন সমস্যার শুরু হয়ে থাকে।
তাই এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা এমন অনেক উপায়ের বিষয়ে জানতে পারবো যেগুলো মেনে চলতে পারলে আপনাদের এই হিসাব ছাড়া অতিরিক্ত টাকা খরচ হওয়ার সমস্যা গুলোর সম্মুখীন হতে হবে না।
বাজে খরচ মানে কি ?
আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই প্রয়োজনের বাইরের যেগুলো জিনিস বা সা-সুবিধা গুলোর ক্ষেত্রে আমরা টাকা খরচ করে থাকি সেই প্রত্যেক খরচ গুলোকেই বাজে খরচ বা অপ্রয়োজনীয় খরচ বলে বলা যেতে পারে।
প্রত্যেক মাসেই এমন অনেক জিনিস পত্র গুলো আমরা কিনে থাকি যেগুলোতে প্রচুর টাকা হাত থেকে বেরিয়ে যায়। আর ভালো করে যাচাই করে দেখলে সেই জিনিস গুলো আমাদের তেমন প্রয়োজনীও থাকেনা।
শুধু ভালো লাগার উপর ভিত্তি করে কিছু না ভেবেই আমরা এই ধরণের অপ্রয়োজনীয় জিনিস বা সেবা গুলোর কারণে প্রচুর বাজে খরচ করে থাকি।
উদাহরণস্বরূপ,
দামি দামি রেস্তোরায় যাওয়া, প্রয়োজন ছাড়া শপিং করা, খুব বেশি ফাস্টফুড খাওয়া, একটি মোবাইল থাকার পরেও নতুন মোবাইল কেনা ইত্যাদি এই ধরণের খরচ গুলো বাজে খরচের ভিতর পরে।
বাজে খরচ কমানোর উপায় এবং কৌশল
বাজে খরচ বাঁচানোর উপায় এমনিতে প্রচুর রয়েছে। তবে, আপনি এই ধরণের অপ্রয়োজনীয় খরচ গুলো বাঁচানোর জন্য নিজের ইচ্ছা শক্তির সাথে কতটা এগিয়ে যেতে পারবেন সেটা সম্পূর্ণ আপনার ওপর।
১. শপিং করার আগে বাজেট বানিয়ে নেওয়া
আমরা যখন বাজারে গিয়ে বা অনলাইনে শপিং করি তখন বিভিন্ন ধরণের কাপড় বা অন্যান্য জিনিসপত্র গুলো দেখে আমাদের মন খুব চঞ্চল হয়ে যায় এবং যেই নতুন কাপড় বা জিনিস গুলো দেখি সেটাই কিনে নিতে মন হতে থাকে।
আর এই কাপড় বা জিনিস কিনার চরম চঞ্চলতার কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের প্রয়োজনের থেকে অধিক কেনাকাটা করে ফেলি যার ফলে হিসেবের থেকেও অধিক বাজে খরচ হয়ে থাকে।
তাই, যখনি বাজারে জবানে তার আগেই একটি লিস্ট তৈরি করে নিতে হবে এবং প্রয়োজনের প্রত্যেকটি জিনিসের তালিকা বানিয়ে নিতে হবে।
এছাড়া, বাজারে যাওয়ার আগেই নিজেকে বুঝিয়ে রাখতে হবে যে, “আমি আমার প্রয়োজন বা লিস্টে লিখে রাখা জিনিসের বাইরে অন্য কোনো জিনিস কিনে টাকার অপচয় করবোনা”.
শুধু এতটুকু কাজ করতে পারলেই দেখবেন এতদিন বাজারে গিয়ে যেভাবে টাকার অপচয় করছিলেন সেগুলো একেবারেই কমে যাবে এবং বাজারে অধিক বেশি পরিমানে হওয়া বাজে খরচ গুলো কমানো যাবে।
২. অফিস টাইমের লাঞ্চ এবং স্ন্যাক্স এর খরচ বাচানো
আমাদের মধ্যে অনেক ব্যক্তি থাকে যারা অফিসে টিফিন নিয়ে যেতে পছন্দ করেনা। ফলে দুপুরের লাঞ্চ এবং বিকালের স্ন্যাক্স বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়।
এমনিতে দেখতে গেলে এক্ষেতের প্রত্যেক দিনের প্রায় ৫০ থেকে ৭০ টাকার সামান্য খরচ তাদের করতে হয়। মূলত এটা অনেক সামান্য খরচ বলে ভাবার কারণেই অনেকেই প্রত্যেক দিনের এই খরচ করে থাকেন।
কিন্তু সম্পূর্ণ মাসের হিসাব করে দেখলে পাবেন, প্রত্যেক দিন হওয়া এই ছোট ছোট খরচ গুলো কিন্তু একসাথে অনেক বড় খরচ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ যদি ব্যক্তিটির স্যালারি ১০ হাজার টাকা হয়, তাহলে প্রতিদিন যদি ৫০ টাকা করে লাঞ্চ এবং বিকালের স্ন্যাক্স এর ওপর ২০ টাকা করে খরচ করা হয় তাহলে মাসে প্রায় ২০০০ টাকা খরচ হচ্ছে।
তাই, যদি ঘর থেকে লাঞ্চ এবং স্ন্যাক্স দপ্তরে বা অফিসে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে এই বাজে খরচ অবশই বেচে যাবে।
৩. জিমের মেম্বারশিপ থেকে খরচ বাচানো
বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে লোকেরা ঘরে যোগা করার থেকে বা মর্নিং ওয়াক করার থেকে জিমে যেতে বেশি পছন্দ করে থাকেন।
এমনিতে, আজকাল জিমে মেম্বারশিপ নিতে অনেক টাকা একসাথে এডভান্সড হিসেবে দিতে হয়, এছাড়া মাসে মাসে টাকা দিতে গেলেও সে অনেক বেশি ফিস (fees) নেওয়া হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে আমরা যদি ঘরে যোগা করার অভ্যাস করি বা সকালে মর্নিং ওয়াক করার জন্য বের হতে পারি, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকার সাথে সাথে জিমের এক্সট্রা খরচও বেচে যায়।
আপনার ঘরে যদি কিছুটা জায়গা রয়েছে, তাহলে জিম বা ব্যায়াম করার জন্য জরুরি সরঞ্জাম গুলো একবার টাকা খরচ করে কিনে নিয়ে চিরদিন বিনা পয়সায় জিম (Gym) করতে পারবেন।
এভাবে, Gym এর membership এর ক্ষেত্রে খরচ হওয়া অতিরিক্ত টাকা আপনি বাঁচিয়ে নিতে পারবেন।
৪. সিগারেট, গুটখা ইত্যাদির থেকে খরচ বাচানো
যারা গুটখা সিগারেট ইত্যাদি এধরণের জিনিস সেবন করে থাকেন তাদের চোখে এই বাজে খরচ গুলো খুব সামান্য হলেও মাসের শেষে হিসেবে করে দেখলে বেশিরভাগ টাকাই তারা এগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলছে।
এর ফলে যেগুলো দরকারি কাজ, চাহিদা বা জিনিস ইত্যাদি থাকে সেগুলো চাহিদা পুরা করার ক্ষেত্রে টাকার অভাব হয়ে থাকে।
তবে, গুটকা, সিগারেটে ইত্যাদির সেবন আপনি একবারেই ছেড়ে দিতে পারবেন না যদিও সেগুলোর সেবনের পরিমান কমিয়েও টাকার অতিরিক্ত খরচ কমাতে পারবেন।
তাই আপনি যদি দিনে ৬টা সিগারেট খান বা ৪পেকেট গুটখা খান তাহলে ৬টার জাগায় ২টা এবং আসতে আসতে আরো কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন।
দেখবেন আপনার মাসের কতগুলো টাকা শুদু এই ছোটো অভ্যাসের জন্য বেচে যাচ্ছে।
৫. মাসের একটি বাজেট বানিয়ে চলা
আমরা যখন মাসের প্রথম স্যালারি পেয়ে থাকি তখন আমাদের হাথে অনেক টাকা থাকার ফলে অনেক কিছু কেনা কাটা করার কথা, ঘুরার কথা মনে এসে থাকে।
কিন্তু আমরা যদি স্যালারি পাওয়ার সাথে সাথেই পুরো মাসের বাজেট বানিয়ে ফেলি তাহলে আমাদের জানা থাকবে কোথায় কত টাকা খরচ করতে হবে ফলে আমরা বাজে খরচ গুলো করার থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি।
তাই বাজে খরচ বাচানোর জন্য সম্পূর্ণ মাসের বাজেট বানিয়ে চলা খুব জরুরি।
৬. প্রয়োজন হিসাবে টিভি বা ফোনের রিচার্জ করা
প্রয়োজন হিসাবেই টিভি, ফোনের বা অন্যান্য সেবা গুলোর জন্য রিচার্জ করা উচিত।
এমনিতে, আমরা এগুলো ছোটো ছোটো খরচে ধ্যান দিয়ে থাকিনা, যার ফলে এক্সট্রা অনেক টাকাই এই রিচার্জ করতে চলে যায়।
আজকাল সকলের ঘরে দুটো তিনটে করে স্মার্ট ফোন থাকার ফলে ৩টি ফোনেই রিচার্জ করা হয়ে থাকে।
যদি ৩০০ টাকা করে রিচার্জ করা হয় তাহলে তিনটি ফোনের ৯০০ টাকা খরচ হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে যদি দুটো ফোনের রিচার্জ করা হয় তাহলেও প্রত্যেক মাসে ৩০০ টাকা করে বাচানো যাবে।
ঠিক একই ভাবে টিভি রিচার্জ করার সময় যেগুলো চ্যানেল আপনার দেখা হয়ে থাকে সেই হিসাবেই রিচার্জ করা দরকার।
কারণ আমরা অনেক সময় দোকানদারের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বেশি টাকার রিচার্জ করে ফেলি যেখানে সেই চ্যানেল গুলো থেকে থাকে যেগুলো আমরা সচরাচর দেখে থাকিনা।
৭. বাইরের খাবারে খরচ বাচানো
আজকাল বেশিরভাগ মানুষ বাইরে খাবার খেতে পছন্দ করে থাকে।
এক্ষেত্রে অফিসের ছুটি হোক বা রবিবার দিন হোক ছুটি মানেই বাইরের খাবার।
এমন অনেক লোকেরা থাকে যারা বিকাল হলেই যেন ফাস্টফুড খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকে।
তাই, কোনো এক ব্যক্তি যদি প্রতিদিন বাইরে ফাস্টফুড খেয়ে থাকে বা মাসের প্রায় বেশিরভাগ দিন গুলোই রেস্তোরায় খেয়ে থাকে তাহলে মাসের শেষে দেখা যাবে যে বাইরের খাবার খেয়েই অনেক টাকা শেষ করে দিচ্ছে।
এক্ষেত্রে যদি ঘরেই নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করে খাবার বানানো হয়ে থাকে তাহলে অনেক টাকা বাচার সাথে সাথে আপনার স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে।
কারণ বাইরের খাওয়া আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
৮. ইলেকট্রিক বিলের খরচ বাচানো
ইলেকট্রিক বিল থেকেও চাইলে অনেক টাকা প্রত্যেক মাসে বাচানো সম্ভব।
বর্তমান সময়ে সকলের ঘরে ঘরে পার্সোনাল টিভি, এসি, কুলার, wifi কানেকশন ইত্যাদি থাকে।
একটি ঘরে যদি তিনটি রুমেই এসি লাগানো থাকে বা টিভি লাগানো থাকে তাহলে মাসের বিল অনেক বেশি আসবে, যার ফলে আপনার স্যালারি থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা বিল দিতেই শেষ হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে যদি হল রুমে একটি টিভি এবং একটি এসি লাগানো হয় এবং কেবল সেগুলোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলে মাসের বিল অর্ধেক হয়ে যাবে এবং বিল থেকেই অনেক টাকা বেচে যাবে।
৯. ব্যাংকে রেকারিং খোলা
বাজে খরচ বাচানোর ক্ষেত্রে সবথেকে বড়ো বিকল্প হলো ব্যাংকে রেকারিং খোলা।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা মাসের শেষে খরচ করার পর যা টাকা বাচে সেটা সেভিং একাউন্টে ফেলে রাখেন।
এর ফলে টাকা কোনো মাসে রাখা হয় আবার কোনো মাসে হয়না।
আবার সেভিং একাউন্ট থেকে যেকোনো সময় টাকা তুলার সুবিধা থাকার ফলে কোনো না কোনো কারণে সেই টাকা খরচ হয়েই যায়।
এক্ষেত্রে ব্যাংকের সেভিং একাউন্টে টাকা না রেখে যদি রেকারিং বা মিউচুয়াল ফান্ড এর একাউন্ট খোলা হয় তাহলে সেখানে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা রাখতে হবে।
এছাড়া, সাথে সাথে টাকা তুলার সুবিধা না থাকার ফলে সেখানে রাখা টাকা নিয়মিত ভাবে জমা হতেই থাকে তবে ছোট খাটো প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তুলে ব্যবহার করা হয়না।
উদাহরণস্বরূপ আপনার স্যালারি যদি ২০ হাজার টাকা হয় তাহলে আপনি কম পক্ষেও চেষ্টা করবেন ৫ হাজার টাকার রেকারিং খোলার।
এতে, এক বছরে আপনার ৬০ হাজার টাকা জমে যাওয়ার সাথে সাথে আলাদা ভাবে ইন্টারেস্ট অবশই আয় করতে পারবেন।
তাই ব্যাংকে বা মিউচুয়াল ফান্ডে রেকারিং খোলা হলে, বাজে খরচ গুলো করার আগেই আপনার মাথায় সেই রেকারিং এর জন্য টাকা রাখার চিন্তা অবশই থাকবে।
Conclusion
আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা বাজে খরচ বাচানোর, টাকা বাঁচানোর উপায়, অতিরিক্ত খরচ কিভাবে কমাবেন, খরচ কমানোর উপায় ইত্যাদি এই বিষয় গুলো নিয়ে কিছু সেরা টিপস গুলো জানতে পারলাম।
এগুলো কাজে লাগিয়ে আপনারা অতিরিক্ত খরচ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।
আশা করি আমার এই আর্টিকেল থেকে আপনাদের কিছু সাহায্য অবশই হবে।
আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে, নিচে কমেন্ট করে অবশই জানিয়ে দিবেন।