টেলিভিশন কে আবিষ্কার করেন: আচ্ছা, বর্তমানের দুনিয়াটাকে কোনোরকম কোনো টিভি, রেডিও, কম্পিউটার বা স্মার্টফোন – ছাড়া ভেবে দেখুন তো? কি? ভাবছেন তো…?
আসলেই, কি এগুলো ছাড়া আধুনিক সমাজ দিন কাটাতে পারবে ?
একেবারেই না, সারাদিন খাটা-খাটনির পর সবাই চায় দিনের শেষে একটু মনটাকে হালকা করতে।
আর, বিনোদনের চেয়ে বড় মুড-মেকার আর কি-ই বা থাকতে পারে ?
আর, ঠিক এই কারণেই আবিষ্কার হয়েছিল যুগান্তকারী টেলিভশন বা টিভির।
আমাদের আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো, টেলিভশনের আবিষ্কারক কে (Who Invented Television in Bengali), আবিষ্কারের ইতিহাস, সময়, কিভাবে কাজ করে, এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে।
সবার প্রথমে চলুন আমরা জানি যে,
টিভি কি ? (What Is Television in Bengali)
মূলত, এই টেলিভিশন বা টিভি (TV) হল একধরণের বিনোদনপ্রদানকারী যন্ত্র; যা মানুষের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই তৈরী করা হয়েছে।
সাধারণ অর্থে বর্ণনা করতে গেলে, টিভি হল সেই ধরণের ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা, যার সাহায্যে স্থির বা চলমান বস্তুর ক্ষণস্থায়ী চিত্রগুলোকে একটা তারের সাহায্যে বা কোনো যন্ত্রাংশের সাহায্যে ও বাতাসের (space) মাধ্যমে, একত্রে প্রেরণ করার জন্যে ব্যবহৃত হয়।
এই সিস্টেমের মাধ্যমে আলো ও শব্দকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে রূপান্তরিত করার পরে, পুনরায় তাদের একটা স্ক্রিন বা পর্দার উপর দৃশ্যমান আলোক রশ্মি ও শ্রবণযোগ্য শব্দ রূপে ফুটিয়ে তোলা হয়।
টেলিভিশন শব্দটির মূল অর্থ হল গ্রীক উপসর্গ ‘টেলি’ বা দূরত্বকে মিটিয়ে ফেলা ও ল্যাটিন শব্দ ভিশন বা “দূর থেকে দেখা“।
টেলিভিশন কে আবিষ্কার করেন ? কত সালে আবিষ্কার হয়
পৃথিবীর নানান দেশের বিজ্ঞানীরাই কম-বেশি একই সময় টিভি আবিষ্কারের জন্যে অনুসন্ধান ও গবেষণা চালাচ্ছিলেন।
তবে, প্রথমবারের মতো সফলভাবে ইলেকট্রনিক টেলিভিশন প্রদর্শিত হয়েছিল, সান ফ্রান্সিসকোতে ১৯২৭ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর।
এই টেলিভশন সিস্টেমটি তৈরী করেছিলেন ফিলো টেলর ফার্নসওয়ার্থ।
তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর।
মূলত, আধুনিক টিভির সূচনা হয় এই শুভক্ষণ থেকেই।
টেলিভিশন আবিষ্কারের ইতিহাস:
এই ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের পূর্ববর্তী মডেলের টিভিগুলো, টিভির থেকেও বেশি টেলিস্কোপের মতো কাজ করতো।
যদিও, সর্বপ্রথম মেকানিকাল টিভি আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২০ শতকের গোড়ার দিকে।
এই ধরণের টেলিভিশনের আবিষ্কর্তা ছিলেন স্কটিশ উদ্ভাবক জন লগি বিয়ার্ড ও আমেরিকান উদ্ভাবক চার্লস ফ্রান্সিস জেনকিন্স।
এঁদেরও আগে, মেকানিক্যাল টেলিভিশনের আবিষ্কার করেন পল গটলিব নিপকো।
তিনি তাঁর এই যন্ত্রের নামকরণ করেছিলেন ইলেকট্রিক টেলিস্কোপ।
এরপর ১৯০৭ সাল নাগাদ রাশিয়ান বরিস রোজিং ও ইংরেজ এ.এ ক্যাম্পবেল-সুইন্টন সম্পূর্ণ নতুন টেলিভিশন সিস্টেম তৈরি করার জন্য যান্ত্রিক স্ক্যানিং সিস্টেমের সঙ্গে ক্যাথোড রে টিউবকে যুক্ত করেন।
আর এর কিছু বছর পরই ফার্নসওয়ার্থ ১৯২৭ সালে সফলতার সাথে তাঁর তথা বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক টেলিভশনের প্রদর্শন করেন।
এই টেলিভিশনে সর্বপ্রথম প্রেরিত হয়েছিল একটা সোজা সাধারণ লাইন।
পরবর্তীতে,
এক সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীর “আমরা কখন এই জিনিসটার থেকে কিছু ডলার দেখতে পাবো?” এই প্রশ্নে, ফার্নসওয়ার্থ এক ঐতিহাসিক কান্ড ঘটান।
তিনি তাঁর টেলিভশন সেটে একটা ডলার চিহ্ন প্রেরণ করেন।
যদিও, সেই সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে, ফার্নসওয়ার্থ তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটিকে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
পরবর্তীকালে, তাঁর এই ধারণাকে অনুসরণ করেই বহু লোকেরা নিজেদের ইলেকট্রনিক টেলিভিশিন নির্মাণ করা শুরু করে।
যদিও, এরপরেও মেকানিক্যাল টেলিভিশনের আবিষ্কারকেরা ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে তাঁদের টেলিভিশন সেটগুলোকে উন্নত করতে নানান ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও, আধুনিক বৈদ্যুতিক টেলিভিশনের দৌলতে এইগুলো ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে।
১৯৩৪ সালের মধ্যে প্রায় সমস্ত টিভিই ইলেকট্রনিক সিস্টেমে পরিবর্তিত হয়েছিল।
এছাড়াও, জাপানে “টেলিভিশনের জনক” নামে পরিচিত ডাঃ কেনজিরো তাকায়নাগি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
যিনি ১৯২৬ সালে বিশ্বের প্রথম ব্যবহারিক ইলেকট্রনিক টেলিভিশন তৈরি করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে।
টিভি হল এমন একটি যন্ত্র, যেটা নিয়ে সারা দুনিয়া জুড়েই, নানান সময়ে গবেষণা চলেছে আর সময়ের সাথে সাথে এই যন্ত্রের বিস্ময়কর উন্নতিও হয়েছে।
১৯ ও ২০ শতকের প্রায় সবটা জুড়েই চলছে, টেলিভশন যন্ত্র ও পরিষেবার নানান রকমের মানোন্নয়ন।
ইলেট্রনিক টিভি প্রথমে সাদা-কালো পর্দায় দৃশ্য ফোটাতে শুরু করলেও, রঙিন টিভি আসতে আসতে পেরিয়ে যায় ১৯৫০-এর দশক।
আধুনিক টেলিভিশন-এর যাত্রাপথ:
মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রনিক টিভির পরবর্তীতে সর্বপ্রথম যে দৃষ্টান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়, তা হল –
১. রঙিন টেলিভিশন:
১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে রঙিন টিভির জমানা শুরু হয়।
১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী জন লগি বিয়ার্ডের প্রস্তাব ও প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে টিভি সাদা-কালো পর্দার বদলে, রঙিন পর্দার সাথেই আসতে শুরু করে।
২. ডিজিটাল টেলিভিশন:
ডিজিটাল টেলিভিশন ভিডিও এবং অডিও উভয় ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রসারতা নিয়ে আসে।
এই ধরণের টিভিগুলো মূলত নানান ফ্রিকোয়েন্সিতে বিভিন্ন চ্যানেল আলাদা করে ধরার ক্ষমতা রাখে।
তবে, এই ধরণের টিভির জনপ্রিয়তা বাড়তে বাড়তে প্রায় ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লেগেছিল।
৩. স্মার্ট টেলিভিশন:
ডিজিটাল টেলিভিশনের উদ্ভাবনই হাইব্রিড টিভির আবিষ্কারের পথকে প্রশস্ত করেছে।
বর্তমানের, আধুনিক স্মার্ট টিভিগুলো শুধুমাত্র একটা ক্লিকেই ওয়েব ও ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হতে পারে।
এর আগেকার টিভিগুলো বেশিরভাগই ক্যাথোড রে টিউব ব্যবহার করে তৈরী করা হলেও, এই সময় থেকে প্লাসমা, LED ও LCD স্ক্রিনের ব্যবহারে এক অত্যাধুনিক স্মার্ট টেলিভিশন প্রযুক্তির জন্ম হয়েছে।
৪. 3D টেলিভিশন:
3D টেলিভিশনের কাজ ১৯২৮ সাল থেকেই জন লগি বিয়ার্ড শুরু করে দিয়েছিলেন।
তিনি 3D টেলিভিশন তৈরির জন্য ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল এবং ক্যাথোড-রে টিউব প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এই যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলেন।
তবে, যাইহোক, এই 3D টেলিভিশন শুধুমাত্র 3D মিডিয়া ফাইল বা 3D চলচ্চিত্রগুলোর সাথেই একমাত্র কাজ করতে সক্ষম।
চলুন, এবার আমরা টেলিভিশনের কাজ সম্পর্কে জেনে নিই –
টেলিভিশন কিভাবে কাজ করে ?
সোজাভাবে বলতে গেলে, যেকোনো টিভির কাজ একটা ভিডিও ক্যামেরার রেকর্ডিং দিয়ে শুরু হয়।
সেই ক্যামেরা টিভি প্রোগ্রামের ছবি ও শব্দকে রেকর্ড করে, সেই ছবি ও শব্দকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে।
তারপরে, সেই বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো কোনো স্যাটেলাইটে পাঠানো হয়।
আর, সবশেষে, সেই স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল গুলো আপনার টিভি সেটে প্রবেশ করার পর, আবার সেগুলো ছবি ও শব্দে পরিণত হয়ে আপনার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়।
টিভি সিগন্যাল:
একটি স্ট্যান্ডার্ড টিভি ক্যামেরা ছবিগুলোকে একধরণের বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিবর্তন করে, যাকে ভিডিও সংকেত বলে।
ভিডিও সংকেতগুলো পিক্সেল নামক ক্ষুদ্র বিন্দু আকারে ছবিগুলোকে বহন করে থাকে।
অন্যদিকে, ক্যামেরার মাইক্রোফোন শব্দগুলোকে অন্য বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিবর্তন করে, যেগুলোকে অডিও সিগন্যাল বলে।
আর, এই দুই ধরণের সংকেতের মিলনেই তৈরী হয় টিভি সিগন্যাল।
ডিজিটাল টিভি, বা ডি-টিভি হল আধুনিক টিভি সংকেত পরিচালনার অন্যতম জনপ্রিয় একটা উপায়।
এই ডিজিটাল টিভি সংকেতগুলো এক ধরণের সংখ্যার কোড হিসাবে ছবি ও শব্দগুলোকে বহন করে থাকে।
মূলত, ডিজিটাল সিগন্যালগুলো স্ট্যান্ডার্ড সিগন্যালের তুলনায় অনেক বেশি তথ্য বহন করতে সক্ষম।
যে কারণে, এখনকার টিভির ছবি ও শব্দের মান খুবই উন্নত প্রকৃতির।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, হাই ডেফিনিশন বা এইচডিটিভি, বা ডিজিটাল টিভিগুলো হল এক ধরণের উচ্চ-মানের দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম।
কোনো টিভি সংকেত নানান উপায়ে আপনার টিভি সেটে পৌঁছতে পারে।
স্থানীয় টিভি স্টেশনগুলো রেডিও তরঙ্গের আকারে বাতাসের মাধ্যমে সংকেত পাঠাতে বা অ্যান্টেনার সাহায্যে সম্প্রচার করতে পারে।
আবার, কেবল টিভি স্টেশনগুলো মাটির তলার তারের মাধ্যমে সংকেত পাঠিয়ে থাকে।
কিংবা, পৃথিবীর কক্ষে প্রদক্ষিণ করা স্যাটেলাইট বা মহাকাশযানও স্যাটেলাইট ডিশ নামক একধরণের অ্যান্টেনায়ও সংকেত পাঠাতে পারে।
আপনার টিভি সেটের সাথে সংযুক্ত ডিভিডি প্লেয়ার, ভিসিআর, বা ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) থেকেও টিভি সংকেত পাঠানো যেতে পারে।
ভিসিআর, ডিভিআর এবং আরও অনেক ডিভিডি প্লেয়ার টিভিতে আসা কোনো টিভি সিগন্যালকে রেকর্ড করে রেখে, পরে সেটাকে আবার চালাতেও পারে।
ডিসপ্লে:
একটা ভালো টিভি সেট ভিডিও সংকেতকে ইলেকট্রন নামক ক্ষুদ্র কণার রশ্মিতে রূপান্তরিত করে।
এই ইলেকট্রনগুলো টিভির পিকচার টিউবের মাধ্যমে পর্দার পিছনে থাকা রশ্মিগুলোকে আলোকিত করে।
এই রশ্মিগুলো টিভির পর্দাতে ছবি তৈরি করার জন্য পর্দার উপরে থাকা পিক্সেলগুলোকে “রঙ” করে।
অন্যদিকে, টিভি সেট লাউডস্পিকারের কাছে অডিও সংকেত পাঠালে তা সেই শব্দকে পুনরায় উৎপাদন করে।
এলসিডি ও প্লাজমা টিভি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ছবি তৈরী করে।
এরা পিকচার টিউব বা ইলেক্ট্রন রশ্মির ব্যবহার করে না।
এই কারণে, এই এলসিডি ও প্লাজমা টিভিগুলো অন্য স্ট্যান্ডার্ড টেলিভিশনের চেয়ে অনেকটাই হালকা ও পাতলা।
লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে বা LCD স্ক্রিনের ক্ষেত্রে, লিকুইড ক্রিস্টাল হল এক ধরণের পদার্থ, যা তরলের মতো প্রবাহিত হয়।
তবে, এর মধ্যে কিছু ক্ষুদ্র কঠিন অংশ বিশেষও থাকে।
টিভির পর্দাগুলো এই লিকুইড ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে আলো ও বৈদ্যুতিক সংকেতগুলোকে প্রবাহিত করে।
বৈদ্যুতিক প্রবাহের কারণে লিক্যুইড ক্রিস্টালের কঠিন অংশগুলো চলে বেড়ায়।
আর, এই ধরণের ডিসপ্লেতে পর্দায় ছবি ফুটিয়ে তুলতে গেলে, একটা নির্দিষ্ট উপায়ে স্ক্রিনগুলো আলো যেতে বা আটকে দেয়।
প্লাজমা ডিসপ্লেগুলোতে প্লাজমা নামক এক ধরণের গ্যাস বহনকারী ছোট রঙের আলো থাকে।
এই প্লাজমার মধ্যে দিয়ে প্রেরিত বৈদ্যুতিক প্রবাহ এটিকে ছবি তৈরির জন্যে আলো সরবরাহ করে।
আমাদের শেষ ,কথা,
টেলিভিশন কে আবিষ্কার করেন, এই বিষয় নিয়ে লিখা আমাদের আজকের আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
টেলিভশন নিয়ে লেখা আমাদের আর্টিকেল আপনাদের পছন্দ হলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।
এছাড়া, আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়া পেজ গুলোতে শেয়ার করার জন্যে অনুরোধ অবশই থাকবে।