What’s Up (কি খবর?) থেকে WhatsApp- এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর।
এখনকার যুগের প্রতিটি মানুষ মনে হয়, হোয়াটস্যাপ ছাড়া দিনে–দুপুরেই অন্ধকারই দেখবেন– কারণ এতই এর চাহিদা!
ঠিক ধরেছেন, আজকে আমরা আমাদের এই আর্টিকেলে আলোচনা করবো, আমাদের সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় অনলাইন মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটস্যাপের আবিষ্কারক কে, আবিষ্কারের ইতিহাস ও নানান খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে।
হোয়াটস্যাপ-এর স্বল্প বৃত্তান্ত:
এই অ্যাপের ওয়েবপেজ অনুসারে, কমপক্ষে সারা পৃথিবীর প্রায় ১৮০ টি দেশের মানুষ হোয়াটস্যাপ ব্যবহার করেন।
তাদের সমীক্ষার অনুযায়ী, বর্তমানে তাদের এই অ্যাপের ২০০ কোটিরও বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী ছড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে।
ভারতের মতো বেশির ভাগ দেশের ক্ষেত্রেই এই অ্যাপ্লিকেশনটি বিনামূল্যে ডাউনলোড ও পরিষেবা দিয়ে থাকে।
তবে, মেসেজ, ছবি, গান, ভিডিও কিংবা অডিও মেসেজ যাই–ই পাঠান, কিংবা যতই অডিও–ভিডিও কল করুন না কেন, এই অ্যাপের সমস্ত পরিষেবা ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া চলবেই না।
এটি চ্যাটিং–এর জন্যে বা ব্যবহারের জন্যে আপনাকে নয় মোবাইল ডেটা কিংবা ওয়াই–ফাই কানেকশন ব্যবহার করতেই হয়।
তবে, এই অ্যাপ্লিকেশনের সবথেকে বড় সুবিধা হল এই যে, আপনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকা মানুষের সাথে সরাসরি ও মুহূর্তের মধ্যেই চ্যাট কিংবা কথা বলতে পারছেন– যেটা কয়েক বছর আগেও কল্পনা করা দুষ্কর ছিল।
আর, এর এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন হোয়াটস্যাপের সমস্ত কথোপকথনের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা প্রদান করায়- এর জনপ্রিয়তা চরমে পৌঁছেছে।
হোয়াটসঅ্যাপ কে আবিষ্কার করেন ?
২০০৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি পথ চলা শুরু হয় বিশ্বের এই সফলতম মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনটির।
প্রথমে, স্টার্টআপ স্টেজে হোয়াটস্যাপের কর্মী সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ জন।
তৎকালীন বহু জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন, যেমন– ফেসবুক মেসেঞ্জার, উইচ্যাট, আইমেসেজ, লাইন–এর মতো অ্যাপ্লিকেশনকে ধুলোয় মিশিয়ে রমরমিয়ে বাজার দখল করেছিল হোয়াটসঅ্যাপ।
তাও, কোনোরকমের বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং স্ট্রাটেজি বা গিমিক ছাড়াই!
আর, এই হোয়াটস্যাপেরই আবিষ্কর্তারা হলেন জ্যান কৌম ও ব্রায়ান অ্যাক্টন।
হোয়াটসঅ্যাপ এর ইতিহাস:
২০০৯ সালে ইয়াহু–এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে জ্যান কৌম ও ব্রায়ান অ্যাক্টন তাঁদের স্টার্টআপ অর্থাৎ একটা ইন্টারেনট মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন বানানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন।
আর, ২০০৯ সালেই কৌম একটা আইফোন নেওয়ার পর, মাত্র কয়েক মাস আগেই লঞ্চ করা অ্যাপ স্টোর ব্যবহারের পরই তিনি অ্যাপ ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন ও অ্যাক্টনের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন।
এই বিষয়ে, তাঁরা পরামর্শ নেওয়ার জন্যে অ্যালেক্স ফিশারম্যানের কাছে গেলে, তিনি তাঁদের সাথে একজন রাশিয়ান আইওএস ডেভেলপার ইগর সোলোমেনিকভের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
হোয়াটস্যাপ 1.0-এর সূচনা:
এর পরের যাত্রা মোটেও মসৃণ ছিল না কিন্তু।
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কারণে কৌম ও অ্যাক্টনের পুঁজি দিনদিন কমে যাচ্ছিল; উল্টে তাঁদের অ্যাপ তৈরিতে সেরকম আশানুরূপ ফল না আসায় কৌম ভাবছিলেন এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার কথা।
কিন্তু, স্টার্টআপ হিসেবে তাঁরা প্রি সীড ফান্ডিং–এর সাহায্যে অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট চালিয়ে যেতে থাকেন।
এর কিছুদিন পরেই কৌম একটি আইওএস অ্যাপ্লিকেশন তৈরী করতে সফল হন, আর তিনি এর নাম দেন ‘WhatsApp Inc.’।
তবে, শুরুর দিকে ডেমো দেওয়ার সময়ে, অনেকের মতোই ফিশারম্যানও এই অ্যাপটিকে অপছন্দ করেন।
কারণ, তখন হোয়াটস্যাপ বিশাল ব্যাটারি খেতো, মাঝেমাঝেই ক্র্যাশ করে যেতো ও আরও নানান জটিল সমস্যা দেখা দিতো এতে।
তা সত্ত্বেও, অ্যাক্টন কৌমকে অ্যাপটি চালিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন।
ফলবশত, আজকে ১৩ বছর ধরে আমরা সফলভাবে ব্যবহার করতে পারছি হোয়াটস্যাপ।
হোয়াটস্যাপে পুশ নোটিফিকেশ যুক্ত করা:
২০০৯ সালেরই জুন মাসে অ্যাপল স্টোর যখন পুশ নোটিফিকেশন ফিচারটি লঞ্চ করে, তখন কৌম হোয়াটস্যাপেও পুশ নোটিফিকেশনের বিষয়টি আনেন।
এই পুশ নোটিফিকেশন আপডেটের পিছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবহারকারীদের তাদের ইনস্টল করা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার না করার জন্যে রিমাইন্ডার দেওয়া।
এই ফিচারটিকে কাজে লাগিয়ে কৌম হোয়াটস্যাপে স্ট্যাটাস-এর ক্ষেত্রে পুশ নোটিফিকেশন নিয়ে আসেন।
অর্থাৎ, যখনই কোনো ব্যবহারকারী তার স্ট্যাটাস পাল্টাবে, ততবারই তার বন্ধুদের কাছে একটা করে স্ট্যাটাস পরিবর্তনের নোটিফিকেশন যাবে।
এই ফিচারটি কিছু দিনের মধ্যেই হোয়াটস্যাপকে জনপ্রিয় করে তোলে।
এই হঠাৎ হওয়া ধারণাটির ব্যবহারই কৌমকে হোয়াটস্যাপ 2.0 ভার্সন তৈরীর জন্যে অনুপ্রাণিত করে।
হোয়াটস্যাপ 2.0:
আমরা ২০২২ সালে যে অ্যাপ্লিকেশনটি দেখতে পাচ্ছি, সেটারই গোড়াপত্তন ছিল হোয়াটস্যাপ 2.0।
ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপের চাহিদাকে আঁচ করেই মার্কেটে নিয়ে আসা হয় হোয়াটস্যাপ 2.0-কে অর্থাৎ এর বিটা সংস্করণকে।
ব্যবহারকারীদের কাছে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে এই অ্যাপ্লিকেশনে লগ ইন করার ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় লেগেছিল।
এমনকি, নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডারদের এসএমএস প্ল্যানের পরিবর্তে, ইন্টারনেটের সাহায্যে অন্যান্য ব্যবহাকারীদের ফোন নম্বরে সরাসরি মেসেজিং করার ব্যাপারটা সকলের কাছেই হোয়াটস্যাপ ব্যবহারের যথার্থতা আরও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সেসময়ে ব্যবহারকারীরা ডাবল–চেক মেসেজ রিসিভড ফিচারটিকে খুব বেশি করে পছন্দ করেছিল।
কারণ, তখন কেবলমাত্র ব্ল্যাকবেরির BBM- মেসেঞ্জারেই এই বিশেষ ফিচারটা একচেটিয়াভাবে ছিল।
অন্যদিকে, যেখানে গুগলের জি–টক ও স্কাইপে ব্যবহারীকারীদের অন্য ব্যবহারকারীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য প্রতিবারই একটা করে অনন্য আইডি শেয়ার করতে হতো; সেখানে হোয়াটসঅ্যাপ এইসব কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি মোবাইল নাম্বার ধরে মেসেজ পাঠাতে সক্ষম ছিল।
যা এটিকে একটা অত্যন্ত উপযোগী অ্যাপে পরিণত করে।
আর, তার সাথে সাথেই মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৫০০০০–এর মতো।
হোয়াটস্যাপের এই 2.0 ভার্শনটি ২০০৯ সালের ২৭শে আগস্ট অ্যাপ স্টোরে জমা দেওয়া হয়।
তবে, এটিতে শুধুমাত্র টেক্সট পাঠানোই সম্ভব ছিল, এমনকি কোনো ধরণের মিডিয়া ফাইলও পাঠানো যেত না।
অন্যদিকে, কৌম ও অ্যাক্টনের পরিকল্পনা ছিল এই অ্যাপটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের সারা বিশ্বের জন্যে উন্মুক্ত করা।
পরবর্তীতে, দুই বছরের মধ্যেই এই অ্যাপটিকে সিম্বিয়ান ওএস, অ্যান্ড্রয়েড ও উইন্ডোজ ওএস–এর জন্য ডিসাইন করা হয়।
এরপরে, অ্যাপ্লিকেশনটিতে ফটো পাঠানোর মতো নতুন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত করা হলে ব্যবহারকারীদের সংখ্যাও আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়।
সেকুওইয়া ক্যাপিটাল থেকে এই অ্যাপে বিনিয়োগ করা হলে, কৌম ও অ্যাক্টন এই অ্যাপের বিনামূল্যের মডেলের পরিবর্তে পেইড মডেল লঞ্চ করার ব্যবস্থা করেন।
কারণ, তাঁদের লক্ষ্য ছিল কোনোভাবেই অ্যাপের মধ্যে বিজ্ঞাপন মডেল না নিয়ে আসা।
আর, এর ঠিক এর দুই বছরের মধ্যেই, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে এই অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২০০ মিলিয়নে পৌঁছায়।
মালিকানার হাতবদল:
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হোয়াটসঅ্যাপকে, ফেসবুক ১৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে অধিগ্রহণ করে।
মার্কেটের মতে, ফেসবুকের কাছে হোয়াটসঅ্যাপ তার সম্ভাব্য ভবিষ্যত প্রতিযোগী হিসাবে পরিণত হয়ে উঠছিল।
সেই সময়ে, ফেসবুক নিজে একটা মোবাইল–ফার্স্ট কোম্পানি হিসেবে, মূল মেসেজিং পরিষেবা প্রদানকারী একক কোম্পানি হয়ে উঠতে চাইছিল।
আর, তখন হোয়াটসঅ্যাপই ছিল ফেসবুক মেসেঞ্জারের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।
এবং, সেসময়ে এর এনগেজমেন্ট রেট ফেসবুকের সহায়ক সংস্থাকেও ছাড়িয়ে গেছিল।
এছাড়াও, ফেসবুকের মতো বিজ্ঞাপন–চালিত প্ল্যাটফর্মের কাছে হোয়াটস্যাপ হয়ে উঠেছিল অফুরন্ত তথ্যের খনির মতো।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ফেইসবুক, বর্তমানে মেটা হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করে, এতে ফেসবুকের মতো ইন্টারফেস নিয়ে এসেছে।
প্রথমদিকে যাচাইকৃত ফোন নম্বর, স্ট্যাটাস, ডিসপ্লে পিকচার ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের ফ্রিকোয়েন্সি–এর মতো তথ্যগুলো মূল কোম্পানির সাথে ভাগ করে নেওয়া হলেও, পরবর্তীতে এই ফিচারগুলোকে আরও ব্যবসা–বান্ধব করার জন্য হোয়াটস্যাপের সাথে যুক্ত করা হয়।
তথ্যের গোপনীয়তা ও হোয়াটস্যাপের বিসনেস মডেল নিয়ে তর্ক–বিতর্ক হওয়ায়, এর মালিক জ্যান কৌম কোম্পানি ত্যাগ করেন।
এর সাথে সাথেই, ব্রায়ান অ্যাক্টনও তাঁর নন–প্রফিট ফাউন্ডেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ও ফেইসবুক ছেড়ে দেন।
যার, ফলে হোয়াটস্যাপের একচেটিয়া মালিক হয়ে দাঁড়ায় মেটা (Meta)।
হোয়াটস্যাপের উদ্দেশ্য:
হোয়াটস্যাপ তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলে যে, তারা এটিকে এসএমএসের বিকল্প হিসেবে পরিষেবা শুরু করেছিল।
তবে, তাদের এই অ্যাপ এখন বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া পাঠাতে ও গ্রহণ করতে সক্ষম, যেমন– টেক্সট, ছবি, ভিডিও, ডক্যুমেন্টস, লোকেশন, ভয়েস, অডিও কল; এমনকি, এটি এখন অনলাইন মানি ট্রান্সফারও করতে পারে।
আপনার ব্যক্তিগত যা কিছু আপনি এর মাধ্যমে সাথে শেয়ার করেন, তাই আপনার গোপনীয়তা রক্ষার কারণেই একে এন্ড–টু–এন্ড এনক্রিপশন দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে।
তাদের প্রতিটা পরিষেবার পিছনে উদ্দেশ্য একটাই রয়েছে যে, ব্যবহারকারীদের বিনা বাধায় সারা বিশ্বের যেকোনো জায়গায় থাকা মানুষের সাথে
সফলভাবে যোগাযোগ করতে সাহায্য করা।
হোয়াটসঅ্যাপ সম্পূর্ণরূপে এনক্রিপ্ট হলে, ২০১৭ সালে এটি উইন্ডোজ ও ম্যাক পিসিগুলোতেও উপলব্ধ করা হয়।
এই অ্যাপটিকে, বিশেষ করে ব্যবসার জন্য ডিজাইন করে একটা নতুন ফিচার যোগ করা হয়।
এর, হোয়াটসঅ্যাপ ফর বিজনেস ভার্শনটি যেকোনো ব্যবসাকে বিনামূল্যে তার ব্যবসায়িক প্রোফাইল খুলতে দেয়৷
আর, এখনও পর্যন্ত এই অ্যাপ্লিকেশনটি কোনই রকমের বিজ্ঞাপন ছাড়াই চলছে।
আমাদের আজকের হোয়াটস্যাপের আবিষ্কারের ইতিহাস / WhatsApp কে আবিষ্কার করেন নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
লেখাটি ভালোলাগলে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।