Technology

ওয়েব ব্রাউজার কেন সবসময় ফ্রি হয়ে থাকে?

ওয়েব ব্রাউজার কেন সবসময় ফ্রি হয়ে থাকে?

আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, পপুলার ওয়েব ব্রাউজারগুলো আগে ফ্রি ছিলো না। ২০-২৫ বছর আগে ওয়েব ব্রাউজার ব্যাবহার করার জন্য ব্রাউজারটি টাকা দিয়ে কিনে ব্যাবহার করতে হতো। ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম NetScape ওয়েব ব্রাউজারটি ফ্রি-টু-ইউজ করে দেওয়া হয় এবং এরপর থেকেই মূলত সব ওয়েব ব্রাউজারই ফ্রিতেই ব্যাবহার করার সুযোগ দেওয়া হয়। আর বর্তমানে তো ফ্রি ছাড়া কোন ওয়েব ব্রাউজারের কথা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু ওয়েব ব্রাউজার এত ছোট কোন প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার নয়।

ওয়েব ব্রাউজারের ডেভেলপমেন্ট এবং মেইন্টেইন করার খরচও অন্যান্য অধিকাংশ লার্জ-স্কেল অ্যাপ্লিকেশনের থেকে বেশি হয়ে থাকে। তাহলে কেন এবং কিভাবে গুগল, মাইক্রোসফট এবং মজিলার মতো কোম্পানিরা তাদের তৈরি ওয়েব ব্রাউজার সম্পূর্ণ ফ্রি-তে ব্যাবহার করতে দিচ্ছে সবাইকে? কিভাবেই বা তারা ওয়েব ব্রাউজার থেকে প্রোফিট জেনারেট করছে? আজকে এটাই আলোচনা করা যাক। দেখা যাক, বর্তমানে জনপ্রিয় ওয়েব ব্রাউজারগুলো কি কি ভাবে প্রোফিট জেনারেট করছে যে তারা ব্রাউজারগুলো সম্পূর্ণ ফ্রি রাখতে পেরেছে।


এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু সমূহ

গুগল ক্রোম

শুরুতে জানা যাক, বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে জনপ্রিয় ওয়েব ব্রাউজার, গুগল ক্রোমের বিজনেস মডেলের ব্যাপারে। এখানে গুগলের প্রোফিট স্কিমটি খুবই সহজ এবং স্পষ্ট। আপনি গুগল ক্রোমের অ্যাড্রেস বাড়ে যখন কোনকিছু টাইপ করে সার্চ করবেন, তখন সার্চ রেজাল্ট সবসময়ই আপনাকে গুগলে দেখানো হবে, বিং কিংবা অন্য কোন সার্চ ইঞ্জিনে নয়। আর গুগলের সার্চ রেজাল্ট পেজে অধিকাংশ সময়ই আপনাকে স্পনসরড কন্টেন্ট এবং অ্যাডস শো করা হবে। গুগলের টোটাল রেভিনিউ এর সবথেকে বড় অংশটিই আসে গুগল সার্চ রেজাল্ট পেজের এসব অ্যাডস এবং স্পনসরড কন্টেন্টগুলো থেকে।

আপনি সার্চ রেজাল্টের বাইরে যখন কোন ওয়েবসাইট কিংবা কোন ব্লগ ভিজিট করেন, তখন আপনি সেখানে যেসব অ্যাডস দেখেন, অধিকাংশ সময় সেগুলোও গুগল অ্যাডসেন্স থেকে সার্ভ করা অ্যাডস হয়ে থাকে। অর্থাৎ সার্চ রেজাল্টের অ্যাডসের পাশাপাশি আপনি ইন্টারনেটে যত অ্যাডস দেখেন, প্রায় সব অ্যাডস থেকে গুগল কিছুটা প্রোফিট করেই থাকে।

আর আপনি যখন গুগল ক্রোম ওয়েব ব্রাউজার ব্যাবহার করে আপনার সব ধরনের ব্রাউজিং করছেন, নিজেদের তৈরি ওয়েব ব্রাউজার হওয়ায় গুগল সহজেই আপনার ব্রাউজিং বিহেভিয়র সম্পর্কে জানতে পারছে এবং আপনার ব্রাউজিং বিহেভিয়রের ওপরে বেজ করে আপনাকে নির্দিষ্ট অ্যাডস টার্গেট করছে।

তাই গুগল ক্রোম যদি সম্পূর্ণ ফ্রি না হয়, তাহলে বর্তমানে যত ইউজার গুগল ক্রোম প্রতিদিন ব্যাবহার করছে, তারা সবাই গুগল ক্রোম ব্যাবহার করতো না। আর গুগল ক্রোমের ইউজার কমে গেলে আল্টিমেটলি গুগলের নিজের অ্যাড রেভিনিউই কমে যাবে। তাই গুগলের নিজের প্রোফিট নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে গুগল ক্রোমের ইউজার বাড়ানো। আর এই কারণেই গুগল ক্রোম সবসময়ই ফ্রি ছিলো, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ, গুগলের টোটাল প্রোফিটের সবথেকে বড় অংশটিই এনে দেয় তাদের ক্রোম ব্রাউজার।

মজিলা ফায়ারফক্স

ফায়ারফক্সের নাম শুনলেই সবার প্রথমে যা মাথায় আসে তা হচ্ছে, নন-প্রোফিট। মজিলা ফায়ারফক্স একটি ওপেন-সোর্স এবং নন-প্রোফিট অর্গানাইজেশনের প্রোডাক্ট। অর্থাৎ, ফায়ারফক্সের ডেভেলপার মজিলা কর্পোরেশন, ফায়ারফক্স থেকে কোন প্রোফিট জেনারেট করার কথা ভাবে না। অর্থাৎ, ব্রাউজারটি থেকে রেভিনিউ জেনারেট করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে, যেমনটা ধারণা করেছেন, প্রোফিট জেনারেট করা তাদের উদ্দেশ্য না হলেও তারা কিছু প্রোফিট করেই থাকে।

কিভাবে? যদিও মজিলা ইউজার ডোনেশন থেকে কিছু ইনকাম করে থাকে, তবে তা তাদের ডেভেলপমেন্ট খরচের তুলনায় খুব বেশি নয়। মজিলা ফায়ারফক্স সবথেকে বেশি প্রোফিট করে থাকে গুগলের কাছ থেকে। আপনি হয়তো জানেন যে, মজিলা ফায়ারফক্সের ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিনও গুগল।

যদি আপনি ফায়ারফক্সের সেটিংস থেকে ম্যানুয়ালি সার্চ ইঞ্জিন চেঞ্জ না করেন, তাহলে ফায়ারফক্সের অ্যাড্রেস বারে কিছু সার্চ করলেও আপনি গুগল থেকে সার্চ রেজাল্ট পাবেন। আর গুগলের সার্চ রেজাল্ট পেজ ভিজিট করলে গুগলের কি লাভ সেটা তো আমরা অলরেডি জানি। তাই ফায়ারফক্স ইউজাররা গুগল সার্চ ব্যাবহার করলেও গুগলেরই লাভ।

আর এই কারণেই, গুগল প্রতি বছর মজিলাকে প্রায় হাফ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা এরও বেশি পে করে থাকে যাতে মজিলা তাদের ফায়ারফক্স ব্রাউজারের ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগল সার্চ ব্যাবহার করে। কারণ, ফায়ারফক্সের ডিফল্ট সার্চ রেজাল্টগুলো গুগলে শো করা হলে তার থেকে গুগল প্রতিবছর যে প্রোফিট পাবে, তা ১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় আরও অনেক বেশি। তাই এটি গুগল এবং মজিলা দুজনের কাছেই ভালো একটি বিজনেস ডিল। আর অধিকাংশ ওয়েব ব্রাউজার ইউজাররাই তাদের ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন চেঞ্জ করেন না। তাই এখানে গুগলের তেমন কোন লস হয়না। তবে বর্তমানে মজিলা আরও কিছু মাইক্রো-সার্ভিস থেকেও কিছু প্রোফিট করে থাকে। যেমন- ফায়ারফক্স ভিপিএন।

মাইক্রোসফট এজ

মাইক্রোসফট এর এজ ব্রাউজারের ব্যাপারটাও ঠিক গুগল ক্রোমের মতোই। পার্থক্য হচ্ছে, গুগল ক্রোম গুগলের ইকোসিস্টেমে এবং মাইক্রোসফট এজ মাইক্রোসফট এর ইকোসিস্টেমে। কিন্তু দুটি কোম্পানির ব্রাউজার থেকে প্রোফিট করার প্ল্যানটি একেবারেই সেইম। গুগল ক্রোমের অ্যাড্রেস বারে যেমন কোনকিছু সার্চ করলে গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যাবহার করে রেজাল্ট দেখানো হয়, তেমনি মাইক্রোসফট এজ ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বারে কোনকিছু সার্চ করলে মাইক্রোসফট এর Bing সার্চ ইঞ্জিন ব্যাবহার করে সার্চ রেজাল্ট দেখানো হয় (যদি আপনি ম্যানুয়ালি সার্চ ইঞ্জিন চেঞ্জ না করেন)।

গুগল যেমন তাদের সার্চ রেজাল্টে স্পনসরড কন্টেন্ট এবং অ্যাডস দেখায়, তেমনি মাইক্রোসফটও তাদের Bing সার্চ রেজাল্টে অ্যাডস দেখায়। তাই কোন ইউজার Bing সার্চ রেজাল্টে আসলে মাইক্রোসফট তাদের থেকে প্রোফিট করতে পারে। আর ঠিক এভাবেই, যেসব মাইক্রোসফট এজ ইউজার এতটাই অজ্ঞ যে তারা ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন চেঞ্জ করতে পারে না, তাদের থেকে কিছুটা প্রোফিট করে নিতে পারে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন। আর সত্যি কথা বলতে, মাইক্রোসফট এজ জাস্ট তাদের উইন্ডোজ ১০ অপারেটিং সিস্টেমের একটা অংশ মাত্র। তাই মাইক্রোসফট সেভাবে ইন্ডিভিজুয়্যালি এজ ব্রাউজার থেকে আলদা করে কোন প্রোফিট করার চিন্তা করেনা।

ব্রেভ ব্রাউজার

ব্রেভ ব্রাউজার, গুগল ক্রোম কিংবা মজিলা ফায়ারফক্সের মতো এত জনপ্রিয় না হলেও বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এর প্রাইভেসি ফোকাসড ব্রাউজিং ইনিশিয়েটিভের কারণে। কিন্তু ব্রেভ ব্রাউজার একেবারেই নন-প্রোফিট কোন প্রোজেক্ট নয়। ব্রেভ ব্রাউজারও ইউজারদের মাধ্যমে রেভিনিউ জেনারেট করে থাকে। তবে ব্রেভ ব্রাউজার কিছুটা আলাদাভাবে প্রোফিটের চিন্তা করে। ব্রেভ ব্রাউজার সাধারনত ইন্টারনেটে অধিকাংশ ট্র্যাকার এবং অ্যাডস ব্লক করে। তবে ব্রেভ ব্রাউজারে BAT ক্রিপ্টোকারেন্সি নামের স্পেশাল একটি ফিচার আছে যা ব্রেভ ব্রাউজারের একটি ইন-হাউজ কারেন্সি হিসেবে ইউজ করা হয়।

ইউজাররা চাইলে ব্রেভ ব্রাউজার ব্যাবহার করার সময় বিভিন্ন ব্রাউজারে ব্রেভ ব্রাউজার স্পেসিফিক স্পেশাল কিছু অ্যাডস দেখতে পারেন এবং অ্যাডস দেখার পরিবর্তে এই BAT কারেন্সি জমা করতে পারেন। এরপর এই কারেন্সি জমা করে ইন্টারনেটে তার প্রিয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটকে টিপ করতে পারেন।

এই টিপ এর কিছু অংশ পেয়ে থাকেন যে ওয়েবসাইটকে টিপ-টি দেওয়া হয়েছে সেই ওয়েবসাইট, আর বাকি অংশ পেয়ে থাকে ব্রেভ ব্রাউজারের ডেভেলপাররা। আর এই টোকেন, রিয়াল ওয়ার্ল্ড কারেন্সির সাথে এক্সচেঞ্জ করে ওয়েবসাইটের ক্রিয়েটর এবং ব্রেভ ব্রাউজার দুজনেই কিছু এক্সট্রা রেভিনিউ জেনারেট করে থাকে।

প্রোফিট করার জন্য এই উপায়টি খুব বেশি ইফেক্টিভ নয়, কারণ খুব কম ব্রেভ ব্রাউজার ইউজাররাই BAT টোকেনের সিস্টেমটি রেগুলারলি ব্যাবহার করেন। তাছাড়া এখনো পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্রেভ রিওয়ার্ডস এর এই সুবিধাটি চালু নেই। তবুও খুব বেশি না হলেও, এই টোকেন সিস্টেমের সাহায্যে ব্রেভ ব্রাউজার কিছুটা ইনকাম করেই থাকে।

অপেরা ব্রাউজার

কয়েক বছর আগে অনেক উইন্ডোজ ইউজারই অপেরা ব্রাউজার ব্যাবহার কর‍তেন। তবে বর্তমানে অপেরা ব্রাউজারের জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। মূলত বর্তমানে উইন্ডোজে অপেরার থেকে অনেক বেটার অপশনস আছে বলে কেউ অপেরা ব্রাউজার ব্যাবহার করেন না। তাছাড়া গত বছর অপেরা কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ইউজার ডাটা কালেক্ট করে চাইনিজ সার্ভারে সেন্ড করা এবং কিছু লোন স্ক্যাম প্রোমোট করার মতো চার্জ এসেছে। এই কারণেও অপেরার ইউজার অনেক কমে গিয়েছে। তবে এখনো কিছু ডেক্সটপ ইউজার অপেরা ব্যাবহার করেন। অপেরা বিজনেস মডেলের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি।

তবে, অপেরা ব্রাউজারে হোমপেজে ট্যাব আকারে যেসব ওয়েবসাইট ফিচার করে রাখা হয়, সেসব ওয়েবসাইট অপেরার হোমপেজে থাকার জন্য নিশ্চিতভাবেই অপেরা-কে পে করে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে অনেক লোকাল স্মার্টফোন কোম্পানির স্মার্টফোনগুলোতে অপেরা ব্রাউজার প্রি-ইন্সটল করে রাখার জন্য অপেরা সেসব কোম্পানির সাথেও পার্টনারশিপ ডিল করে থাকে। আবার, হতে পারে অপেরা তাদের বিল্ট-ইন ফ্রি প্রক্সির সাহায্যে ইউজার ডাটা কালেক্ট করে এবং সেগুলো সেল করে থাকে। এছাড়া অপেরা ব্রাউজারের প্রোফিট সোর্স সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আর তেমন কিছু জানা যায়নি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button