ইন্টারনেট

ইন্টারনেট আবিষ্কার করেন কে? ইন্টারনেট তৈরির নেপথ্যের গল্প!

ইন্টারনেট আবিষ্কার করেন কে? ইন্টারনেট তৈরির নেপথ্যের গল্প!

ইন্টারনেট এর সূচনা হয়েছে কয়েকটি কম্পিউটারকে নেটওয়ার্ক কাঠামোর সাথে যুক্ত করারর মধ্য দিয়ে। কেউ তখন জানেনি যে, ইন্টারনেট আজকের মত এরকম একটি ভার্চুয়াল দুনিয়াতে রূপান্তরিত হবে। ইন্টারনেট এর মত বিশাল এই ফিজিক্যাল এবং ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ককে কোন ব্যাক্তি বা কোম্পানি তৈরি করেনি। যুগে যুগে অনেক কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট,ইঞ্জিনিয়ার,প্রোগ্রামার একটি সংযুক্ত নেটওয়ার্ককে নানা ফিচারে উন্নীত করে আজকের ইন্টারনেটে রূপান্তরিত করেছেন। তাই কখনই ইন্টারনেটের আবিষ্কারকের অবদানটি কেবল একক একজনকে বা একক প্রতিষ্ঠানকে দিলে হবেনা। কেবল একটি পরিপূর্ণ নেটওয়ার্কই নয়, এর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি যেমন,আইপি অ্যাড্রেস,ডোমেইন,ইমেইন, প্যাকেট ট্রান্সফারিং ইত্যাদি ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণ কার্যকরী করে তুলেছে। আর এগুলো একজন তৈরি করেনি, বছর বছর পরপর বহু অগ্রনী ব্যাক্তিবর্গ এসব আবিষ্কার করেছেন।

আরপানেটকে বর্তমান আধুনিক ইন্টারনেট এর প্রতিকৃতি তথা মডেল হিসেবে আক্ষায়িত করা হয়। আরপানেটে আধুনিক ইন্টারনেটের মৌলিক পরিকাঠামোটি সর্বপ্রথম প্রকাশ পায়। আরপানেটকে তৈরি করা হয়েছিল আমেরিকান মিলিটারিদের যোগাযোগব্যবস্থা কে আরো কার্যকরী এবং উন্নত করে তোলার জন্য।

আধুনিক ইন্টারনেট তথা এই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এর ধারনার শুরু ছিল একটি ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক থেকে। আর এই নেটওয়ার্কটটির নাম ছিল আরপানেট । এই আরপানেটটি ছিল আমেরিকান অ্যাডভান্সড রিসার্চ এজেন্সি এর তৈরি একটি নেটওয়ার্ক (Advanced Research Projects Agency Network বা ARPANET)। সর্বপ্রথম আরপানেট এর মত একটি নেটওয়ার্ক এর আইডিয়া দেন এবং তৈরি করেন আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট টেইলর । আরপানেট নামক এই আন্তঃকম্পিউটার নেটওয়ার্কটির কাজ শুরু হয় ১৯৬৬ সাল থেকে। নেটওয়ার্কটি পাশাপাশি শহর তথা এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় এবং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর মেইনফ্রেম কম্পিউটার এর সাথে যুক্ত থেকে একটি আঞ্চলিক শক্তিসালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। এই আরপানেটেই রেইমন্ড টমলিনশন পরবর্তীতে প্রথম ইলেকট্রনিক মেইল আআবিষ্কার করে প্রথম ইমেইল পরীক্ষা করেছিলেন।

আমরা জানি যে, আধুনিক ইন্টারনেটে ডাটা পারাপার হয় প্যাকেট সুইচিং / ডাটা প্যাকেট এর মাধ্যমে। এখানে যেকোনো প্রকার ডাটা হোক তা কয়েকটি গানিতিক তথা সংখ্যার প্যাকেট আকারে ভাগ হয়ে থাকে। আর মজার কথা হল আরপানেটে ডাটা পারাপারের জন্য এই প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তিটিই ব্যবহার হত। আরপানেট ব্যবহার করে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটার এক্সেস করা যেত খুব সহজে।

বর্তমান আধুনিক ইন্টারনেটের পথিকৃত এই আরপানেট মডেলটি ১৯৬৬ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে। এখানে ১৯৭৭ সালে আরপানেট কেমন ছিল তার ছবি দেওয়া হলঃ

ভিন্ট সার্ফ এবং রবার্ট কান হলেন আধুনিক ইন্টারনেট তৈরির পেছনকার অন্যতম দু’জন কিংবদন্তী। কেননা তারা ইন্টারনেট প্রোটোকল (IP Address) এবং ট্রান্সমিশন কনট্রোল প্রোটোকল (TCP) আবিষ্কার করেছিলেন। ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তির ফলে ইন্টারনেটের যেকোন প্রকার কমিউনিকেশন HTTP অথবা FTP এই IP অ্যাড্রেস এর মাধ্যমে পরিচালিত হতে থাকে। IP এবং TCP কে বলা হয়ে থাকে ইন্টারনেট প্রোটোকল সুইট। এখানে একটি IP অ্যাড্রেস থেকে অন্য আইপি অ্যাড্রেস এর ভেতর যোগাযোগ এর মধ্যে TCP সেই যোগাযোগকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলে। বর্তমান আধুনিক ইন্টারনেটের যোগাযোগের প্রান হল এই ইন্টারনেট প্রোটোকল সুইট।
নাম্বার এর মত আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করে বড় বড় মেইনফ্রেম কম্পিউটার বা সার্ভারের বিভিন্ন পেজ বা ফাইল এক্সেস করা যায়। তবে এসব বড় নাম্বার মনে রাখা অনেকসময় কষ্টকর, তাই ১৯৮৫ সালে প্রবর্তিত আধুনিক ইন্টারনেটের এক নতুন অংশ “ডোমেইন নেম”।

আপনি ওয়্যারবিডিে প্রবেশ করেছেন wirebd.com এই ডোমেইনটি লিখে বা এই ডোমেইনটি লেখা কোনো লিংকে ক্লিক করে। ওয়্যারবিডি মূলত একটি আইপি অ্যাড্রেস এর ওপর ভিত্তি করে রয়েছে। আর এটি হল ওয়্যারবিডিের সার্ভারের আইপি অ্যাড্রেস। আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করেও কিন্তু ওয়েবসাইট ভিজিট করা যেত। তবে এসব আইপি অ্যাড্রেস মনে রাখা কষ্টকর, তাছাড়াও এতে অনেকরকম সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আর এই সমস্যা দূর করতে পল মোকাপেট্রিস এবং জন পোস্টেল নামক দুজন কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট ৮০’র দশকে ডোমেইন নেম সিস্টেম আবিষ্কার করেন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ডোমেইন নেম আইপি অ্যাড্রেসকে লুকিয়ে ফেলে বা হাইড করে।

পৃথিবীর সবচাইতে পুরাতন ডোমেইন তথা সর্বপ্রথম রেজিস্ট্রার্ডকৃত ডোমেইন নেম হল symbolics.com। বর্তমানে এই ডোমেইনটি THE BIG INTERNET MUSEUM বা সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট যাদুঘর এর ওয়েবসাইট এর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

৭০ এর দশকে আরপানেটে যোগাযোগব্যবস্থার আরেকটি বিপ্লব সাধিত হয়, পারস্পরিক বার্তা পাঠানোর সিস্টেম ইমেইল ব্যবস্হা আবিষ্কার এর মাধ্যমে। রেইমন্ড টমলিনশন ছিলেন ইমেইল তথা ইলেকট্রনিক মেইল ব্যবস্হার জন্মদাতা। তিনিই ইমেইল এর ক্ষেত্রে এই @ সিম্বলটিকে বাছাই করেছিলেন। প্রথমদিকে আইপি অ্যাড্রেস এর সাথে ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে ডোমেইন অ্যাড্রেস/নেম এর সাথে ইমেইল অ্যাড্রেস তৈরি করতেও এই @ সিম্বলটিকেই ব্যবহার করা হয় এবং হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথম একটি পরীক্ষামূলক মেইল সেন্ড করেছিলেন, আর তিনি এই মেইলে লিখেছিলেন “something like QWERTYUIOP”।

৯০ এর দশকে টিম বার্নারস লি HyperText MarkUp Language বা HTML ল্যাংগুয়েজ তৈরি করেন। যে ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে ডকুমেন্টকে ওয়েব সংস্করন আকারে প্রকাশ করা শুরু হয়, আজও যা করা হচ্ছে। এর থেকে ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়েবপেজ তৈরি শুরু হয় এবং এর সাথে যুক্ত হয় আরও অনেক ল্যাংগুয়েজ। টিম বার্নারস লি ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট ইন্টারনেটে তার প্রথম ওয়েবসাইট লঞ্চ করেন, যেখানে তিনি তথ্য অনুসন্ধান এর জন্য ওয়েব এর ভূমিকার বর্ননা দেন। এটিই ছিল মূলত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তথা www ( www কি?) এর সূচনা।


প্রযুক্তি খুবই প্রসস্থ এবং যেকোনো সময়ই পরিবর্তনশীল, প্রতি সময়ই প্রযুক্তিকে কেউ না কেউ পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে সমৃদ্ধ করেই চলেছে। তাই প্রযুক্তিগত কোনো কিছু আবিষ্কারের পেছনে একজনকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। ইন্টারনেট যুগে যুগে কতগুলো অগ্রনী বিজ্ঞানী তথা কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট,প্রোগ্রামার,ইঞ্জিনিয়ারদের পরিশ্রমের ফসল। কোনো একজন ব্যাক্তি ইন্টারনেটকে আজকের এরকম পরিস্হিতিতে নিয়ে আসেনি। এসব অগ্রনী মানুষদের চেষ্টার ফলে আজকের ইন্টারনেট একটি “ইনফরমেশন সুপারহাইওয়ে” তে পরিনত হয়েছে।

ইন্টারনেটের পরীক্ষামূলক ও বাস্তবরূপ যদিও ১৯৬৬ সালে আরপানেট এর মাধ্যমে দেখা গিয়েছিল। তবুও বহু আগে থেকে অনেকে ইন্টারনেটের মত একটি সক্রিয় নেটওয়ার্ক এর স্বপ্ন দেখে আসছিলেন। আধুনিক বিদ্যুৎ এর আবিষ্কারক নিকোলা টেসলা ১৯০০ সালে “ওয়ার্ল্ড ওয়্যারলেস সিস্টেম” এর আইডিয়া উপস্হাপন করেছিলেন, যার কার্যক্রম ছিল আধুনিক ইন্টারনেটের আনুরূপ। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সালে প্রযুক্তি ভিসনারী পল অটলেট ও ভ্যানিভার বাস বই এবং মিডিয়া ফাইল এর সার্চেবল বা অনুসন্ধানযোগ্য স্টোরেজ সিস্টেম তৈরি করেছিলেন। আরপানেটে বিজ্ঞানী লিকলাইডার এর তৈরি “প্যাকেট সুইচিং” ডাটা ট্রান্সফার প্রযুক্তি ব্যবহার এর মধ্য দিয়ে আধুনিক ইন্টারনেট এর সূচনা শুরু হয়। আশা করি ইন্টারনেট সম্পর্কিত আজকের এই প্রবন্ধটি সবার ভালো লেগেছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button