ইলেকট্রনিক্স

মাদারবোর্ড কি ? মাদারবোর্ড এর কাজ এবং বিভিন্ন অংশের বর্ণনা

মাদারবোর্ড এ কি কি থাকে ? মাদারবোর্ড এর বিভিন্ন অংশের বর্ণনা

আমরা সবাই জানি, যে কম্পিউটারের মতো যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চলে।

আর, আমরা এই কথাটার সাথেও কম-বেশি সবাই পরিচিত, যে একটা কম্পিউটারের মাদারবোর্ড খারাপ হওয়া মানে, সাময়িকভাবে সেই কম্পিউটারটা নষ্ট হয়ে যাওয়া।

আসলে, বৈদ্যুতিক শক্তি-নির্ভর এই যন্ত্রগুলোতে যে বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহকারী ব্যবস্থা থাকে, সেই ব্যবস্থা প্রথমে পরবর্তী তড়িৎ প্রবাহকে (অল্টারনেটিভ কারেন্ট) কম ভোল্টেজের সমতড়িৎ প্রবাহে (ডিরেক্ট কারেন্ট) পরিণত করে কম্পিউটারের মাদারবোর্ডে পাঠায়।

আর, মাদারবোর্ড সেই বৈদ্যুতিক শক্তিকে গ্রহণ করে কম্পিউটারের সমস্ত অংশগুলোকে একসাথে সংযুক্ত করে একটা একক প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে।

যেই প্ল্যাটফর্মটি কম্পিউটারের সিপিইউ, মেমরি, হার্ড ড্রাইভ, ভিডিও কার্ড, অপটিক্যাল ড্রাইভ, সাউন্ড কার্ড এবং অন্যান্য পোর্ট এবং এক্সপেনশন কার্ডকে সরাসরি বা তারের মাধ্যমে যুক্ত করে রাখে।

 

আজকে আমরা এই আর্টিকেলে মূলত একটি কম্পিউটার মাদারবোর্ড কি কি কাজ করে থাকে আর এটির মূল অংশগুলো কি কি ও তার যথাযথ বর্ণনা নিয়ে আলোচনা করবো।

মাদারবোর্ড কি বা কাকে বলে – (What is motherboard in Bangla)

সাধারণ অর্থে, মাদারবোর্ড হল কম্পিউটারের সিপিইউ যন্ত্রের মধ্যে থাকা একটা সরু ও চ্যাপ্টা বোর্ডের মতো অংশ।

এই অংশটিকে কম্পিউটারের শিরদাঁড়া বলে চিহ্নিত করা হয়, কারণ এটি ছাড়া যেকোনো কম্পিউটার যন্ত্র একেবারেই প্রায় অচল।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় এই মাদারবোর্ড লজিক বোর্ড বা মেইন বা প্রধান বোর্ড নামেও পরিচিত।

যেকোনো কম্পিউটার সিস্টেমে একটা মাদারবোর্ডের প্রধান কাজ থাকে, কম্পিউটার সিস্টেমের সমস্ত উপাদানগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করে উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপন করা।

আসলে, এই মাদারবোর্ডের সাহায্যেই কম্পিউটারের ভিতরে ও বাইরে থাকা যন্ত্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পরিচালনা করা হয়ে থাকে।

সংজ্ঞা অনুসারে, একটি মাদারবোর্ড হল একটি কম্পিউটার যন্ত্রের প্রধান প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড (PCB)।

যা কম্পিউটরের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, যেমন হার্ড ড্রাইভ, সিপিইউ ও জিপিউ-এর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বলেই, আমরা কম্পিউটারে মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করে উঠতে পারছি।

এই মাদারবোর্ড অংশটি সিপিইউ-এর কম্পিউটার কেসের যেকোনো একটা ধারে লাগানো থাকে।

আর, এই যন্ত্রাংশের মধ্যে নানাধরণের জরুরি কন্ট্রোলার ও চিপস থাকে, যা একত্রে চিপসেট নামে পরিচিত।

আমরা জানি, যে কম্পিউটার হল মূলত ইনপুট, প্রসেসিং ও আউটপুট ডিভাইসের সমষ্টি।

আর, তথ্য প্রসেস বা প্রক্রিয়াকরণই হল যেকোনো কম্পিউটরের মূল কাজ।

সেক্ষেত্রে, এই তথ্য প্রসেসিং-এর জন্যে সমস্ত কম্পিউটার যন্ত্রে থাকে অতি প্রয়োজনীয় প্রসেসর যন্ত্রাংশটি, যা এই মাদারবোর্ডের মধ্যেই অবস্থিত থাকে।

 

তাহলে আশা করছি, কম্পিউটার মাদারবোর্ড বলতে কি বুঝায় বা মাদারবোর্ড কাকে বলে, বিষয়টা বুঝতেই পেরেছেন।

মাদারবোর্ডের ইতিহাস আলচনা:

১৯৮০-এর দশকে সর্বপ্রথম আইবিএম (IBM) কোম্পানি মাদারবোর্ড ব্যবহার করা শুরু করে।

তবে, তখন মাদারবোর্ডকে প্ল্যানার বলে বলা হতো।

এই যন্ত্রাংশের সাহায্যেই প্রধাণত কম্পিউটারের বিভিন্ন উপাদান গুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো।

এমনকি, এটি সমস্ত পেরিফেরালক ডিভাইসকেও সংযুক্ত করতো।

আর, এই কারণেই পরবর্তীতে একে মাদারবোর্ড বা কম্পিউটারের প্রধান পরিচালনাকারী যন্ত্রাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

আর, এই মাদারবোর্ডের অন্যান্য এক্সটেনশন বা বর্ধিত যন্ত্রাংশগুলোকে সিস্টারবোর্ডও বলা হয়ে থাকে।

কম্পিউটার মাদারবোর্ড পরিচিতি:

একটি মাদারবোর্ড আসলে হল বিভিন্ন জটিল কম্পিউটার যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরী একটা গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম।

কিন্তু, আসলে এই সরু, চ্যাপ্টা মাদারবোর্ড তৈরী হয়ে থাকে সিলিকন ও প্লাস্টিকের তৈরী উপাদান থেকে।

আর, মাদারবোর্ডের প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ডের মধ্যে থাকে একাধিক ফাইবারগ্লাসের স্তর ও তামার সংযোগকারী চিহ্ন এবং পাওয়ার ও সিগন্যাল বিচ্ছিন্ন করার জন্যে থাকে তামার প্লেন।

যাতে, অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক সংকেত মাদারবোর্ডের সূক্ষ সার্কিটের কোনো ক্ষতি না করতে পারে।

তাছাড়াও, এই যন্ত্রাংশটিতে থাকে নানা ধরণের জটিল কেবিলস, শ্লটস এবং পোর্টস।

মাদারবোর্ড এ কি কি থাকে ? মাদারবোর্ড এর বিভিন্ন অংশের বর্ণনা

নিচে মাদারবোর্ডের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ে আলোচনা করা হল।

১. RAM শ্লটস:

রেন্ডম এক্সেস মেমরি বা RAM-কে আমরা কম্পিউটারের প্রধান মেমোরি হিসেবে জানি।

এই প্রধান স্টোরেজ ডিভাইসের কাজ হল প্রচুর পরিমাণে বাইটস বা বাইনারি সংখ্যার আকারে তথ্যকে কম্পিউটারে সঞ্চিত রাখা।

কম্পিউটারের মধ্যে সক্রিয় এপ্লিকেশন বা কাজ গুলোর সাথে জড়িত তথ্য গুলো এই র্যাম (RAM) মেমোরিতে অস্থায়ী ভাবে জমা হয়ে থাকে।

২. সিপিইউ পাখা ও হিটসিংক:

বৈদ্যুতিক সংকেতের গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণ ও প্রেরণের সময় সিপিইউ-তে যে প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি তৈরী হয়, তা কমিয়ে কম্পিউটারকে সুষ্ঠূভাবে পরিচালনা করতে কাজে লাগানো হয় এই সিপিইউ পাখা ও হিটসিংককে।

৩. নর্থ ব্রিজ:

নর্থব্রিজ হল একধরণের কন্ট্রোলার বা নিয়ামক, যা CPU কে ​​ফ্রন্টসাইড বাস বা কেবলের (FSB) মাধ্যমে মেমরির সাথে কম্পিউটারকে সংযুক্ত রাখে।

৪. সাউথ ব্রিজ:

সাউথ ব্রিজ হল একধরণের কন্ট্রোলার বা নিয়ামক, যা কম্পিউটরের ইনপুট ও আউটপুট প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৫. ক্যাপাসিয়াটর্স:

একটি ক্যাপাসিয়াটর্স হল মাদারবোর্ডের অন্তর্ভুক্ত একটা ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক উপাদান।

এটি বিভিন্ন উপাদানগুলো, যেমন ভিডিও কার্ড, হার্ড ড্রাইভ, সাউন্ড কার্ড ইত্যাদিতে একটা নিয়মিত ও সমান ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করে যাতে সহজে শর্ট সার্কিট না হয়।

৬. রেসিস্টরস:

এটি একধরণের ইলেকট্রনিক উপাদান, যা একটা বৈদ্যতিক সার্কিটে তড়িৎ প্রবাহকে প্রতিরোধ করে।

৭. CMOS ব্যাটারী (কমপ্লেমেন্টরি মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর):

এই উপাদানের প্রধান কাজ হল প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহ মাধ্যমের বদলি হিসেবে কাজ করা।

৮. পিসিআই শ্লটস (পেরিফেরাল কম্পোনেন্ট ইন্টারকানেক্ট):

এই পিসিআই স্লটস হল একটা কম্পিউটারের নিজস্ব বা ইনবিল্ট স্লটস, যা নেটওয়ার্ক কার্ড, সাউন্ড কার্ড, ডিস্ক কন্ট্রোলার, মডেম ও আরও নানা পেরিফেরাল ডিভাইসের মতো বিভিন্ন হার্ডওয়্যার উপাদান গুলো সংযুক্ত করতে সাহায্য করে।

৯. SATA (সিরিয়াল অ্যাডভান্সড টেকনোলজি এটাচমেন্ট) কেবিলস:

এই কেবিলগুলো অপটিক্যাল ড্রাইভ এবং হার্ড ড্রাইভের মতো ডিভাইসগুলিকে মাদারবোর্ডের সাথে সংযুক্ত করে।

১০. BIOS (বেসিক ইনপুট আউটপুট সিস্টেম):

BIOS হল একধরণের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, যা কম্পিউটারের সিপিইউ দ্বারা ব্যবহার করা হয়।

এই প্রোগ্রামের সাহায্যে কম্পিউটারে পাওয়ার বাটন প্রেস করার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পিউটার তার স্টার্ট-আপ পদ্ধতিকে সঞ্চালন করতে পারে।

১১. প্রসেসর:

মাদারবোর্ডে থাকা এই প্রসেসর উপাদানটি কম্পিউটারের সমস্ত নির্দেশাবলী বা তথ্য সম্পাদন করে, গণনা করে এবং ইনপুট/আউটপুট অপারেশন গুলোকে সমন্বিত করে থাকে।

১২. এজিপি (এক্সেলেরেটেড গ্রাফিক্স পোর্ট):

এই এজিপি হল একটা সমান্তরাল এক্সপেনশন কার্ড স্ট্যান্ডার্ড, যেটা 3D কম্পিউটার গ্রাফিক্সকে আরও উন্নতমানের করে তুলতে কম্পিউটার সিস্টেমে একটা ভিডিও কার্ড যুক্ত করার জন্য তৈরী করা হয়েছে।

১৩. আইডিই (ইন্টেগ্রেটেড ড্রাইভ ইলেক্ট্রনিক্স):

আইডিই হল একধরণের ইলেকট্রনিক ইন্টারফেস স্ট্যান্ডার্ড, যা কম্পিউটারের মাদারবোর্ডের বাস বা কেবলের সাথে কম্পিউটারের ডিস্ক স্টোরেজ ডিভাইসের সংযোগ রক্ষা করে।

১৪. প্রসেসর সকেট:

এটি কম্পিউটার সিস্টেমের মাইক্রোপ্রসেসর এবং মাদারবোর্ডের মধ্যে প্রধান সংযোগকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে।

১৫. আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট):

ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট হল একধরণের মাইক্রোচিপ।

এই আইসির উপর হাজার-হাজার কিংবা শত-শত বৈদ্যুতিক উপাদান যেমন রেসিস্টর, ক্যাপাসিটর এবং ট্রানজিস্টর তৈরি করা থাকে।

একটি আইসি সাধারণত মাইক্রোপ্রসেসর, এমপ্লিফায়ার, টাইমার বা কম্পিউটার মেমরি হিসাবে কাজ করে থাকে।

মাদারবোর্ড এর কাজ কি ?

মাদারবোর্ড মূলত বেশ কিছু প্রধান কাজ থাকে। সেগুলো হল-

১. এটি কম্পিউটারের বিভিন্ন উপাদানে বৈদ্যুতিক শক্তি বা সংকেত পাঠিয়ে থাকে।

২. মাদারবোর্ড মূলত কম্পিউটারের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে থাকে।

আর, এই মাদারবোর্ড হার্ড ডিস্ক, RAM ও সিপিইউ-এর মতো যন্ত্রাংশগুলোর কাছাকাছি ইনস্টল করা থাকে।

৩. মাদারবোর্ড একরকমের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে, যার উপর নানাধরণের এক্সপেনশন বা বিস্তারকারী শ্লটস থাকে।

এতে কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা অন্যান্য ডিভাইস বা ইন্টারফেস কম্পিউটারে ইনস্টল করতে পারে।

৪. মাদারবোর্ড কম্পিউটারের বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সাহায্য করে এবং তাদের মধ্যে একটা ইন্টারফেস তৈরি করে রাখে।

৫. এই যন্ত্রাংশ বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে, সেগুলো হল – মাইক্রো-ATX, NLX, মিনি-ATX ও ইত্যাদি।

আমাদের শেষ কথা,,

কম্পিউটার মাদারবোর্ড কি ? (what is a motherboard) নিয়ে লেখা আমাদের আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।

আজকের এই কম্পিউটার মাদারবোর্ড পরিচিতি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশই আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করবেন।

এছাড়া, আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে, নিচে কমেন্ট করে অবশই জানিয়ে দিতে পারবেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button